বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)

প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের পরবর্তী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর রচিত সাহিত্য মধুর ও কাব্যধর্মী ভাষায় অখণ্ড ও অবিচ্ছিন্ন সত্তায় ধারণ করেছে প্রকৃতি ও নিম্নশ্রেণীর মানবজীবন। তাঁর ছোটগল্পগুলোর মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে গীতিকবির ব্যক্তিত্ব।

 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে চব্বিশ পরগনার মুরারিপুর গ্রামে (মাতুলালয়) জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস চব্বিশ পরগনার ব্যারাকপুর গ্রাম।

তিনি 'চিত্রলেখা' (১৯৩০) পত্রিকা এবং হেমন্তকুমার গুপ্তের সাথে 'দীপক' (১৯৩০), পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

১৯২১ সালে প্রবাসী পত্রিকায় 'উপেক্ষিতা' নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

তিনি ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০ সালে (১৫ কার্তিক, ১৩৫৭) বিহারের ঘাটশীলায় মারা যান।

প্র. তাঁর রচিত উপন্যাসসমূহ কী কী? ১১তম বিসিএস লিখিত।

উ. 'পথের পাঁচালী' (১৯২৯): এটি তাঁর প্রথম ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এটি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত। মূল চরিত্র: অপু, দুর্গা। উপন্যাসটি তিনটি অংশে বিভক্ত। যথা: বল্লালী বালাই, আমআঁটির ভেঁপু ও অক্রুর সংবাদ। সত্যজিৎ রায় এ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ।

'অপরাজিত' (১৯৩১): এটিকে 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড বলা হয়। উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে মাসিক 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে (১৩৩৮)। 'আলোক সারথী' নামে এ উপন্যাসটির প্রথমে নামকরণ করা হয়েছিল। উপন্যাসের নায়ক অপুর শৈশব ও কৈশোর জীবন, মা সর্বজয়ার মৃত্যু, অপর্ণার সাথে বিবাহ ও শিশুপুত্র কাজলের মাধ্যমে পুনরায় প্রিয় শৈশবের প্রিয় গ্রাম নিশ্চিন্দিপুরের স্মৃতিমন্থন এ উপন্যাসের মূল কাহিনী। অপরাজিত উপন্যাসের একটি অংশ নিয়েই সত্যজিৎ রায় 'অপুর সংসার' সিনেমা তৈরি করেছেন।  

'দৃষ্টিপ্রদীপ' (১৯৩৫): অবাস্তব ও অধিবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এর কাহিনী।

'আরণ্যক' (১৯৩৮): এ উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে অরণ্যাচারী মানুষের জীবন। ভাগলপুরের নিকটবর্তী বনাঞ্চলের মানুষের জীবনের সাথে প্রকৃতির সম্পর্কের টানাপড়েন, বিচিত্র চরিত্র, তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আনন্দ এ উপন্যাসের মূল কাহিনী।

'আদর্শ হিন্দু হোটেল' (১৯৪০): এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাজারী ঠাকুরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে প্রতিষ্ঠা লাভ এবং মানুষের ভালোবাসা অর্জনের কাহিনীই এ উপন্যাসের মূল বিষয়।

'অনুবর্তন' (১৯৪২): বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তি অভিজ্ঞতার রূপায়ণ এ উপন্যাস। গ্রামের মানুষের মধ্যে সামান্য স্বার্থ নিয়ে দলাদলি এবং পরিণামে ট্র্যাজিক পরিণতিই এ উপন্যাসের মূল সুর।  

'দেবযান' (১৯৪৪): এটি প্রেমতত্ত্ব ও পরলোকতত্ত্ব ভিত্তিক উপন্যাস। অবাস্তব ও অধিবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এর কাহিনী ও চরিত্রবিন্যাসের নিয়ামক।

'ইছামতি' (১৯৪৯): ইছামতি নদীর তীরবর্তী গ্রামে প্রচলিত সংস্কার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নারী জাগরণ, ইংরেজ শাসকদের প্রভাবে কৃষিনির্ভর বাঙালির বাণিজ্য চেতনা এবং নীলচাষের প্রতিবাদ, নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনকথা এ উপন্যাসের আলেখ্য। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপন্যাসের জন্য 'রবীন্দ্র পুরস্কার' (মরণোত্তর) লাভ করেন।(বাজারের অন্যান্য বইয়ে উপন্যাসটির প্রকাশসাল দেওয়া হয়েছে ১৯৫০। কিন্তু 'বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান' এ দেওয়া হয়েছে ১৯৪৯)

'অশনি সংকেত' (১৯৫৯): এ উপন্যাসটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে রচিত। এটি ধারাবাহিকভাবে মাতৃভূমি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (বাজারে প্রচলিত বইয়ে বলা হয়েছে যে, অত্বিক ঘটক এ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। প্রকৃতপক্ষে সত্যজিৎ রায় এ উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৩ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন)। এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বাংলাদেশের চিত্রনায়িকা ববিতাকে চলচ্চিত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়া হয়।  

'বিপিনের সংসার' (১৯৪১), 'দম্পতি' (১৯৫২)।

  • পথের পাঁচালী (উপন্যাস) = বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 
  • পথের দাবী (উপন্যাস) = শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্র. 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের পরিচয় দাও। ৩৮তম বিসিএস লিখিত

উ. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' (১৯২৯)। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'বিচিত্রা' পত্রিকায়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সজনীকান্ত দাসের রঞ্জন প্রকাশনালয়, কলকাতা থেকে। ভাগলপুরে চাকরি করার সময় তিনি এ উপন্যাস রচনা করেন। এ উপন্যাসের পটভূমিতে আছে বাংলাদেশের গ্রাম ও পরিচিত মানুষের জীবন। বল্লালী বালাই, আমআঁটির ভেঁপু ও অক্রুর সংবাদ নামে তিনটি ভাগে বিভক্ত এ উপন্যাস। 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের প্রধান অংশই হলো একটি শিশুর চৈতন্যের জাগরণ, প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে শিশুর বেড়ে উঠা। মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে তাদের পরিচয়। বিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে অপু, অপুর বাবা হরিহর রায়, মা সর্বজয়া, বোন দুর্গা ও দূর সম্পর্কের পিসি ইন্দির ঠাকরুন নিয়ে তাদের জীবন যাত্রার কথাই এ উপন্যাসের মুখ্য বিষয়। দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে তাদের দিন কাটে। অপু ও দুর্গার মধ্যে খুবই ভাব। তারা কখনো চুপচাপ গাছতলায় বসে থাকে, আবার কখনো মিঠাইওয়ালার পিছে পিছে ছোটে, কখনো ভ্রাম্যমান বায়োস্কোপ দেখে। একদিন তারা বাড়িতে না বলে ট্রেন দেখার জন্য অনেক দূরে চলে যায়। ভাল কাজের আশায় অপুর বাবা শহরে গেলে তাদের অভাব বেড়ে যায়। এরইমধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে দুর্গার জ্বর হয় এবং চিকিৎসার অভাবে দুর্গা মারা যায়। পরে হরিহর বাড়ি ফিরে এলে জীবিকার সন্ধানে পৈতৃক ভিটা ছেড়ে কাশীর পথে যাত্রা শুরু করে। কাশীতে গিয়ে বসবাস শুরু করার কিছুদিন পর হরিহর মারা গেলে মা সর্বজয়া অন্যের বাড়ীতে রান্নার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু অপুর মন পড়ে থাকে নিশ্চিন্দিপুরে। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: অপু, দুর্গা, সর্বজয়া, ইন্দির ঠাকরুন। এ উপন্যাসটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, 'এই বইখানিতে পেয়েছি যথার্থ গল্পের স্বাদ। এ থেকে শিক্ষা হয়নি কিছুই। দেখা হয়েছে অনেক যা পূর্বে এমন করে দেখিনি।'

প্র. 'অশনি সংকেত' উপন্যাসের পরিচয় দাও।

উ. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করুণ ফল ১৩৫০ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষ। আর এ দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস কিভাবে শান্ত প্রকৃতির আবহমান গ্রাম বাংলায় প্রভাব বিস্তার করে, তারই নিখুঁত চিত্রের বর্ণনা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অশনি সংকেত' (১৯৫৯) উপন্যাস। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে ১৯৪৪-৪৬ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে মাসিক 'মাতৃভূমি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের গ্রাম ব্যারাকপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং বনগ্রাম মহকুমা শহর এ উপন্যাসের ক্ষেত্রভূমি। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বাঙালি কৃষিজীবীরা কেমন হন্য হয়ে উঠেছিল, তারই প্রামাণ্য চিত্র এ উপন্যাস। 'অনঙ্গবৌ' নামের চরিত্রটি বাঙালির প্রতিদিনের সুখ-দুঃখময় সংসারেও খুঁজে পাওয়া যায়। 

  • আরণ্য জনপদে (প্রবন্ধ) = আবদুস সাত্তার
  • আরণ্য সংস্কৃতি (প্রবন্ধ) = আবদুস সাত্তার
  • আরণ্যক (উপন্যাস) = বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্র. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যান্য রচনাবলি কী কী?

ছোটগল্প: 'মেঘমাল্লার' (১৯৩১), 'মৌরীফুল' (১৯৩২), 'যাত্রাবদল' (১৯৩৪), 'কিন্নর দল' (১৯৩৮), পুঁইমাচা'।

আত্মজীবনী: 'তৃণাঙ্কুর' (১৯৪৩)।

ভ্রমণকাহিনী: 'অভিযাত্রিক', 'বনে পাহাড়ে', 'হে অরণ্য কথা কও'।

প্র. 'গোরক্ষিণী সভা' কী?

উ. ১৮৯৩ সালে ভারতে গরু রক্ষার জন্য যে মিশন শুরু হয় তাকে 'গোরক্ষিণী সভা' বলে। এ সভার প্রতিষ্ঠাতা মহারাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক নেতা গঙ্গাধর তিলক। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'গোরক্ষিণী সভা'র ভ্রাম্যমান প্রচারক হিসেবে বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করে এর পক্ষে জনমত তৈরি করেন।

 

Reference: অগ্রদূত বাংলা