মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১)

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য মুসলিম সাহিত্যিক বা গদ্য লেখক, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন। তিনি কাব্য, নাটক, প্রহসন, উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম রচিত সমৃদ্ধ ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী ধারার প্রবর্তক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। 

  • মীর মশাররফ হোসেন ১৩ নভেম্বর, ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 
  • ছদ্মনাম গাজী মিয়া।
  • তাঁর সাহিত্য গুরু কাঙাল হরিনাথ। 
  • ১৯ মে, ১৮৬৫ সালে মশাররফ হোসেনের সাথে নাদির হোসেনের সুন্দরী কন্যা লতিফননেসার বিবাহ স্থির হয়। কিন্তু বিয়ের রাতে নাদির হোসেন কর্তৃক কন্যা বদল করে তাঁর কুরূপা ও বুদ্ধিহীনা কন্যা আজিজননেসার সাথে মশাররফের বিবাহ সম্পন্ন হয়। তাই দাম্পত্য জীবনে তিনি সুখী হননি। ফলে তিনি বিবি কুলসুমকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। 
  • তিনি কলকাতার 'সংবাদ প্রভাকর' (১৮৩১) ও কুমারখালির 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' (১৮৬৩) পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতেন। 
  • তিনি 'আজিজননেহার' (১৮৭৪) ও 'হিতকরী' (১৮৯০) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। 
  • তিনি ১৯ ডিসেম্বর, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। (১৯১১- উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা), (১৯১২- বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান) 

 

প্র. মীর মশাররফের উপন্যাসসমূহ কী কী? 

উ. 'রত্নবর্তী' (১৮৬৯): এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এটি বাংলা সাহিত্যে মুসলমান রচিত প্রথম উপন্যাস। 

'বিষাদসিন্ধু' (১৮৮৫-৯১): এটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস যা তিন খণ্ডে বিভক্ত। যথা: মহররম পর্ব, উদ্ধার পর্ব, এজিদবধ পর্ব। এতে উপসংহারসহ ৬৩টি অধ্যায় রয়েছে। এটি ইতিহাস, উপন্যাস, সৃষ্টিধর্মী রচনা ও নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের বিবিধ সংমিশ্রণে রোমান্টিক আবেগ মাখানো এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। হিজরি ৬১ সালের মহররম মাসে ইসলামের সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ (স.) এর দৌহিত্র ইমাম হাসান ও হোসেনের সাথে উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়ার একমাত্র পুত্র এজিদের কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধ এর বিষয়বস্তু। 

'উদাসীন পথিকের মনের কথা' (১৮৯০): এটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। তিনি এটি 'উদাসীন পথিক' ছদ্মনামে রচনা করেন। এর প্রথম খণ্ডে আছে নীলকর কেনির অত্যাচার ও কৃষক ভূস্বামীদের প্রতিরোধের মুখে মি. কেনির শোচনীয় পরাজয় এবং দ্বিতীয় খণ্ডে আছে ঔপন্যাসিকের ব্যক্তি জীবনের আলেখ্য। 'তাহমিনা' (১৮৯৭)। 

  • রত্নবতী (উপন্যাস) - মীর মশাররফ হোসেন 
  • রত্নাবলী (নাটক) - রামনারায়ণ তর্করত্ন 
  • রত্নদ্বীপ (উপন্যাস) - প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় 
  • রত্নপরীক্ষা (গদ্যগ্রন্থ) - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 

প্র. 'রত্নবতী' উপন্যাসের পরিচয় দাও। 

উ. বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন রচিত উপন্যাস 'রত্নবতী' (১৮৬৯)। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। রাজপুত্র সুকুমার ও মন্ত্রীপুত্র সুমন্তের মধ্যে 'ধন বড় না বিদ্যা বড়' এ বিতর্ক ও বিতর্কের সমাধানই 'রত্নবতী' উপন্যাসের মূল উপজীব্য। প্রকৃতপক্ষে, এটি রূপকথা জাতীয় শিক্ষামূলক দীর্ঘ গল্প। ঔপন্যাসিক এটিকে 'কৌতুকাবহ উপন্যাস' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 

প্র. 'বিষাদসিন্ধু' উপন্যাসের নায়ক কে? 

উ. তিন পর্বে বিভক্ত 'বিষাদসিন্ধু'র 'মহররম পর্বে বর্ণিত হয়েছে দামেস্ক অধিপতি মাবিয়া পুত্র এজিদের প্রণয়াসক্তি, ব্যর্থতা এবং এর পরিণাম। হাসানপত্নী জয়নবের প্রতি এজিদের প্রণয়-দৌর্বল্য থাকলেও জয়নবকে সে আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়নি। এই ব্যর্থতার সূত্রে হাসানের প্রতি সে বৈরী মনোভাব পোষণ করে এবং তার ষড়যন্ত্রকৌশলে হাসানকে জীবন দিতে হয়। এজিদ হাসান অনুজ হোসেনকেও ধ্বংস করতে উদ্যত হয় এবং অবশেষে কারবালা প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধে অপ্রস্তুত হোসেনকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে সক্ষম হন।

'উদ্ধার পর্বের কাহিনী অংশে আছে বিপন্ন হোসেন পরিবারের অস্তিত্বরক্ষা এবং ক্রোধান্ধ দুর্জয় বীর মোহাম্মদ হানিফার প্রতিশোধ গ্রহণের বিবরণ।

'বিষাদসিন্ধু'র শেষখণ্ড 'এজিদবধ পর্বে হানিফার এজিদ হত্যার প্রচেষ্টা, এজিদের ভূ-গর্ভস্থ গুপ্তকক্ষে পলায়ন ও জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নারকীয় কষ্টভোগ, দৈবনির্দেশে বহু প্রাণক্ষয়কারী হানিফার প্রাকৃতিক বন্দিত্ব এবং হোসেন বংশধর জয়নাল আবেদীনের রাজ্যলাভের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। উপসংহারে ঔপন্যাসিক সত্যের জয় ও পাপের পরিণামফল ভোগের অবশ্যম্ভাবিতার কথা স্মরণ করেছেন।  

এজিদ নাকি হোসেন? কে নায়ক?

এজিদের কামনা-বাসনাকে কেন্দ্র করেই এ উপন্যাসের সূচনা এবং তার শোচনীয় বিপর্যয়েই এ উপন্যাসের কাহিনীর সমাপ্তি। তার কর্মকাণ্ডকে অবলম্বন করেই 'বিষাদসিন্ধু'র কাহিনী পল্লবিত হয়ে উঠেছে। ঔপন্যাসিক এজিদ চরিত্র চিত্রণে যতটা আন্তরিক ও মনোযোগী, অন্যান্য চরিত্র অঙ্কনে ততখানি নিবিষ্ট হতে পারেননি। রিপুশাসিত রক্ত-মাংসের একজন মানুষের প্রকৃতি, প্রবণতা ও বাস্তবতা নিয়ে এজিদ চরিত্রটি উপস্থাপিত। এ প্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরী বলেন, 'গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা স্পষ্ট এবং প্রদীপ্ত চরিত্র এজিদের। তার চিন্তায়-আচরণে, আবেগে-অভিব্যক্তিতে এমন একটা দৃঢ়, গাঢ় ও ঔজ্জ্বল্য আছে যে অন্যান্য চরিত্র তার পাশে নিতান্ত মর্যাদাহীন বলে মনে হয়।' নীতিবিদদের দৃষ্টিতে এজিদের ক্রিয়াকর্ম যত গর্হিত ও অভিশপ্ত বিবেচিত হোক না কেনো, চরিত্র বিচারের সাহিত্যিক মানদণ্ডে এজিদের মতো প্রাণময় পূর্ণাবয়ব পুরুষ সমগ্র উপন্যাসে দ্বিতীয়টি নেই। এজিদ পাপী, ধর্মদ্রোহী এবং ইন্দ্রিয়পরবশ। কিন্তু এজিদের পাপের প্রকৃতি অসামান্য, তার বিকাশ প্রলয়ঙ্কারী। তার পরিণাম যেমন ভয়াবহ তেমনি শোকাবহ।  

উপন্যাসের সূচনাতেই এজিদ তার মনের গোপন আকাঙ্ক্ষা আবেগকম্পিত কণ্ঠে প্রকাশ করেছে। 'পিতঃ। আমার দুঃখ অনন্ত। এ দুঃখের সীমা নাই, উপশমের উপায় নাই। আমি নিরুপায় হইয়াই জগতের আশা হইতে একেবারে বহুদূরে দাঁড়াইয়া আছি। আমার বিষয় বিভব, ধন, জন, ক্ষমতা সমস্তই অতুল, তাহা আমি জানি।... কিন্তু আমার অন্তরে যে মোহিনী-মূর্তির সুতীক্ষ্ণ নয়ন-বাণে বিদ্ধ হইতেছে, সে বেদনার উপশম নাই। পিতঃ। সে বেদনার প্রতিকারের প্রতিকার নাই। যদি থাকিত, তবে বলিতাম।... আর বলিবার সাধ্য নাই। হয় দেখিবেন, না হয় শুনিবেন, এজিদ বিষপান করিয়া যেখানে শোকতাপের নাম নাই, প্রণয়ে হতাশ নাই, অভাব নাই এবং আশা নাই, এমন কোন নির্জন স্থানে এই পাপময় দেহ রাখিয়া সেই পবিত্রধামে চলিয়া গিয়াছে।'

এজিদের জীবন বেদনা অচরিতার্থ আর অসাফল্যে পূর্ণ। যে জয়নবের জন্য এজিদ মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতার সকল সীমা অতিক্রম করে চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জয়নব লাভের আশা ফলবতী হয়নি, বরঞ্চ বলি হয়েছে বহুসংখ্যক মানুষের জীবন। কৃতকর্মের জন্য তার মনে অনুশোচনা জেগেছে, আত্মদ্বন্দ্ব আর বিবেক দংশনে জর্জরিত হয়ে বলে সে: 'কেন হেরিলাম? সে জ্বলন্ত রূপরাশির প্রতি কেন চাহিলাম? হায়। হায়। সেই এক দিন, আর আজ এক দিন। কি প্রমোদ। প্রেমের দায়ে কি না ঘটিল? কত প্রাণ ছিঃ ছিঃ কত প্রাণের বিনাশ হইল।' [উদ্ধার পর্ব]

তীব্র শোচনাজাত আত্মগ্লানি আর অন্তরের প্রচ্ছন্ন হাহাকারে দীর্ণ এজিদের এ স্বগতোক্তি তার চরিত্রের একটি ভিন্ন দিকের পরিচয় তুলে ধরে।

এজিদ চরিত্র সৃষ্টিতে মশাররফ হোসেন 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র রাবণ চরিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হন বলে অনুমান করা যায়। পুরাণ ও ইতিহাসের এই দুই ভিলেন চরিত্র উনিশ শতকীয় নবচেতনার প্রাণিত দুই মহৎ শিল্পীর হাতে নতুন তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রকাশিত। অমিত শক্তির অধিকারী এই দুই চরিত্রেই নিয়তি নির্ধারিত বিপর্যয় ও পতন সম্পূর্ণ মানবিক এবং করুণা ও দীর্ঘশ্বাস উদ্রেককারী। আবু হেনা মোস্তফা কামালের মতে, 'এজিদ বিষাদসিন্ধুর কাহিনীর নিয়ন্ত্রকশক্তি। হাসান-হোসেন বা কারবালার কাহিনী এই উপন্যাসে উপলক্ষ মাত্র। মূল লক্ষ্য এজিদ, তার প্রেমতৃষ্ণার ভয়াবহ পরিণতি নির্দেশ। তাই শিল্পী মশাররফ এজিদ চরিত্র রূপায়ণেই তাঁর শ্রেষ্ঠ মনোযোগ অর্পণ করেছিলেন। ... মধুসূদনের বেলায় ব্যক্তিগত সহানুভূতি ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বিরোধ ঘটেনি, পক্ষান্তরে মশাররফ হোসেন শিল্পী ও ব্যক্তি চৈতন্যের টানাপোড়েনে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত।'

মুনীর চৌধুরীর মতে, 'এই উপন্যাসে পাপ ও প্রেমের অবস্থান সমান্তরাল। প্রেম তার জীবনকে আনন্দ ও সুখে পূর্ণ করেনি, পক্ষান্তরে পাপ তার জীবনকে বেদনা-বিষে করে তুলেছে জর্জরিত। নিয়তি নির্ধারিত এক মানবভাগ্যের করুণ পরিণতি নেমে এসেছে এজিদের জীবনে। প্রণয় বঞ্চিত আত্মদ্বন্দ্বে পরাভূত এক বিক্ষত মানুষের করুণ মর্মস্পর্শী কাহিনী হয়ে উঠেছে বিষাদসিন্ধু। যথার্থই, ইতিহাসের প্রকৃত মরুপ্রান্তর নয়, এজিদের প্রেমদীর্ণ হৃদয়ই এখানে কারবালায় রূপান্তরিত হয়েছে। বিষাদের উত্তাল তরঙ্গসমূহের উৎস এজিদের হৃদয়-সিন্ধু।'  

হোসেনও ধর্মপ্রাণ ও সজ্জন। তার মধ্যে কর্তব্যবোধ, নির্ভীকতা, আবেগপ্রবণতা, ক্ষমাশীলতা ও সরলতার প্রকাশ আছে। তবে এজিদের সঙ্গে প্রতিতুলনায় হোসেন অনুজ্জ্বল ও নিষ্প্রভ। তাঁর ভূমিকা অনেকটাই পূর্বনির্ধারিত। তবুও অভাবিত মানবিক সংকটের মুখে যখন অস্তিত্ব বিপন্নপ্রায় তখনও চিন্তা ও আচরণে হোসেন অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও জীবন্ত। মহররম পর্বে হোসেনের উপস্থিতি কম থাকলেও উদ্ধার পর্বে ধীরে ধীরে সে ঘটনার মূলে প্রবেশ করেছে, কাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু অপ্রস্তুতভাবে অদৃষ্টের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হানিফার পথচলা শতগুণে ত্বরান্বিত হয়েছে। হানিফার চিন্তার কেন্দ্রে অবস্থান করেছে ইমাম হোসেন। এজিদবধ পর্বে এসেও আমরা দেখি সবকিছুর কেন্দ্রে ইমাম হোসেনের মৃত্যু। তাই নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বিচারে ইমাম হোসেনকে নায়ক ধরা যায়। কিন্তু যে চরিত্রের মাঝে doing ও suffering বেশি থাকবে, মূলত সেই চরিত্রই নায়ক চরিত্র হিসেবে পরিগণিত হবে। এ উপন্যাসে doing ও suffering বৈশিষ্ট্যগুলো বেশি প্রতিফলিত হয়েছে এজিদের ক্ষেত্রে। মশাররফের ধর্মচেতনা ও স্বজাতির কাছে দায়বদ্ধতা তাকে অনিবার্যভাবে হাসান-হোসেনের পক্ষাবলম্বী করে তুলেছে। এখানে সত্যের জয় বন্দনায় তার মনোযোগ নিবেদিত। কিন্তু শিল্পী মশাররফের সহানুভূতি ও মমত্ববোধ যে এজিদের প্রতিও ধাবিত, তাও বিস্মৃত হওয়া চলে না। বাহ্যত হাসান-হোসেনের প্রতি তার পক্ষপাত, কিন্তু শিল্পী মনোরাজ্যের গভীরে 'দুরাত্মা' এজিদই আন্তরিক অনুরাগ ও মমতায় প্রতিষ্ঠিত।

অতএব, আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, এজিদই নায়ক।

প্র. 'জমীদার দর্পণ' নাটকের পরিচয় দাও।

উ. মীর মশাররফ হোসেন রচিত মুসলিম চরিত্র অবলম্বনে বিখ্যাত নাটক 'জমীদার দর্পণ' (১৮৭৩)। লেখকের মতে, 'এ নাটকের কিছুই সাজানো নয়, প্রচলিত সমাজের অবিকল ছবি' তুলে ধরা হয়েছে। অত্যাচারী ও চরিত্রহীন জমিদার হায়ওয়ান আলীর অত্যাচার এবং অধীনস্ত প্রজা আবু মোল্লার গর্ভবতী স্ত্রী নূরন্নেহারকে ধর্ষণ ও হত্যার কাহিনী এর মূল বিষয়।

প্র. মীর মশাররফের আত্মজীবনীসমূহ কী কী?

উ. 'গাজী মিয়ার বস্তানী' (১৮৯৯): এটি আত্মজীবনীমূলক ব্যঙ্গাত্মক রচনা। লেখক 'ভেড়াকান্ত' ছদ্মনামে ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমাজের অনাচার, অন্যায়, সামাজিক দুর্নীতি এবং এ সমাজভুক্ত মানুষের নৈতিক অধঃপতন, মনুষ্যত্ব ও হৃদয়হীন আচরণের চিত্রই এখানে চিত্রিত করেছেন।

'আমার জীবনী' (১৯১০): লেখকের আঠারো বছরের জীবন কাহিনী এতে অন্তর্ভুক্ত।

'কুলসুম জীবনী' (১৯১০): এটি লেখকের দ্বিতীয় স্ত্রী কুলসুমকে কেন্দ্র করে লিখিত।

প্র. মীর মশাররফের প্রহসনসমূহ কী কী?

উ. 'এর উপায় কি' (১৮৭৫): বাংলা সাহিত্যে মুসলমান রচিত প্রথম প্রহসন। উনিশ শতকে এক শ্রেণির লোক স্ত্রীর প্রতি অবহেলা দেখিয়ে মদ ও পতিতাবৃত্তিতে আকৃষ্ট হয়ে নানা ধরনের অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হয়েছিল, তারই চিত্র এ প্রহসন।  

'ভাই ভাই এইতো চাই' (১৮৯৯), 'ফাঁস কাগজ' (১৮৯৯), 'বাঁধা খাতা' (১৮৯৯)।

প্র. মীর মশাররফের কাব্যসমূহ কী কী?

উ. 'গোরাই ব্রীজ বা গৌরী সেতু' (১৮৭৩), 'পঞ্চনারী' (১৮৯৯), 'প্রেম পারিজাত' (১৮৯৯), 'মদিনার গৌরব' (১৯০৬), 'মোসলেম বীরত্ব' (১৯০৭), 'বাজীমাৎ' (১৯০৮)।

প্র. মীর মশাররফের গানের সংকলনের নাম কী?

উ. 'সংগীত লহরী' (১৮৭৭)।

প্র. মীর মশাররফের প্রবন্ধ কোনটি?

উ. 'গো-জীবন' (১৮৮৯): কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে যে কোনো কারণেই হোক গো-হত্যা অনুচিত। হিন্দু-মুসলিম এই দুই ধর্মের অনুসারীদের একত্র করার প্রয়াসে তিনি এটি রচনা করেন। এই গ্রন্থ রচনার জন্য তাঁকে মামলায় জড়িয়ে পড়তে হয়।

'এসলামের জয়' (১৯০৮)।

প্র. 'উদাসীন পথিকের মনের কথা' সম্পর্কে আলোচনা করুন? (৩১/১১তম বিসিএস লিখিত)

উ. মীর মশাররফ হোসেন রচিত 'উদাসীন পথিকের মনের কথা' (১৮৯০) একটি ইতিহাস আশ্রিত উপাখ্যানধর্মী আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। 'উদাসীন পথিক' নামে মশাররফ হোসেন এ গ্রন্থে তার ব্যক্তিগত জীবনের পটভূমিতে স্বীয় পারিবারিক ইতিহাস ও সমসাময়িক বাস্তব ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছেন। এখানে লেখক তার পারিবারিক ইতিবৃত্ত বর্ণনা ও নিজের পিতা-মাতাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার সাথে চিত্রিত করেছেন এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে হিন্দু-মুসলিমের মিলন কামনা প্রত্যাশা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এটি উপন্যাস বা আত্মজীবনীমূলক রচনা নয়, এটাকে বলা যায় লেখকের আত্মজীবনী-নির্ভর বাস্তব ও কাল্পনিক ঘটনার মিশেলে উপন্যাসসুলভ সাহিত্যিক উপস্থাপনা।

প্র. মীর মশাররফের নাটকসমূহ কী কী?

উ. 'বসন্তকুমারী' (১৮৭৩): এটি বাংলা সাহিত্যে মুসলমান রচিত প্রথম নাটক। বৃদ্ধ রাজা বীরেন্দ্র সিংহের যুবতী স্ত্রী রেবতী সপত্নী পুত্র নরেন্দ্র সিংহকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখাত হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে। পরিণামে সমগ্র রাজ পরিবারটি ধ্বংস হয়ে যায়, এটিই এ নাটকের মূল বিষয়। মশাররফ এটি নওয়াব আব্দুল লতিফ কে উৎসর্গ করেন।  

'বেহুলা গীতাভিনয়' (১৮৮৯): এতে ইংরেজ শাসকদের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে তাদের প্রতিরোধ করার আহবান জানিয়েছেন।

'জমীদার দর্পণ' (১৮৭৩), 'নিয়তি কি অবনতি' (১৮৮৯), 'টালা অভিনয়' (১৮৯৭)।

Reference: অগ্রদূত বাংলা