বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নাটক লেখেন দীনবন্ধু মিত্র। তিনি ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রেরণায় কবিতা রচনা দিয়ে সাহিত্যজীবন শুরু করেন। বাংলার আধুনিক নাট্যধারার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক দীনবন্ধু মাইকেল প্রবর্তিত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাট্যরচনার পথে না গিয়ে বাস্তবধর্মী সামাজিক নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন।
প্র. দীনবন্ধু মিত্র রচিত বিখ্যাত নাটক কোনটি? ২৭তম বিসিএস লিখিত।
উ. 'নীলদর্পণ' (১৮৬০): এটি ঢাকার বাংলা প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ। এতে মেহেরপুরের কৃষকদের ওপর নীলকরদের নির্মম নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে। নাটকটি প্রথম মঞ্চায়ন হয় ঢাকায়। এ নাটকটি প্রথম প্রকাশের সময় দীনবন্ধুর নাম ছিল না। এ নাটকের অভিনয় দেখতে এসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মঞ্চের অভিনেতাদের লক্ষ্য করে জুতা ছুঁড়ে মেরেছিলেন। নাটকটির ঘটনা, রচনা, মুদ্রণ, প্রকাশ ও প্রথম মঞ্চায়ন সব কিছুই বাংলাদেশে বলে, একে 'বাংলাদেশের নাটক' বলা হয়।
প্র. দীনবন্ধু মিত্রের অন্যান্য নাটকগুলো কী কী?
উ. 'জামাই বারিক' (১৮৭২): প্রহসনধর্মী নাটকটি ১৪ ডিসেম্বর, ১৮৭২ সালে কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। বিন্দুবাসিনী ও বগলার কলহ এবং দুই স্ত্রীর বৃত্তান্ত এ নাটকের মূল বিষয়। এ নাটকে দেখা যায়, সে সময়কালে দিনের বেলায় স্ত্রীর সাথে জামাইদের দেখা করার কোনো সুযোগ ছিলো না, ফলে রাতে জামাইদের ডাক পড়ত অন্তঃপুরে। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: বিজয়বল্লভ, অভয়কুমার, কামিনী, বগলা, বিন্দুবাসিনী।
'কমলে কামিনী' (১৮৭৩): নাটকটি ২০ ডিসেম্বর, ১৮৭৩ সালে কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকটি কাছাড় অঞ্চলের অভিজাত কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক ভাবে দুর্বল মানুষদের আখ্যান। চরিত্র: সমরকেতু, শশাঙ্কশেখর, গান্ধারী, সুশীলা, সুরবালা।
'নবীন তপস্বিনী' (১৮৬৩), 'লীলাবতী' (১৮৬৭)।
প্র. 'নীলদর্পণ' নাটকের সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সামাজিক মূল্য বেশি'- আলোচনা করুন। [২৮তম বিসিএস লিখিত।
উ. দীনবন্ধু মিত্র রচিত বিখ্যাত নাটক 'নীলদর্পণ' (১৮৬০), এটি ঢাকার বাংলা প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ। এতে মেহেরপুরের কৃষকদের ওপর নীলকরদের নির্মম নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে। নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক নাটক হিসেবে রচিত হলেও এর মধ্যে গ্রাম্যসমাজের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা তৎকালীন নাট্যসাহিত্যে ছিল একান্ত অভিনব। এ নাটকের মাধ্যমে এ দেশের শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, সভ্য মুখোশের অন্তরালে বর্বরতা ইত্যাদি সামাজিক দিক সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে। তাই 'নীলদর্পণ' নাটকের সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সামাজিক মূল্য বেশি'। ১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন A Native ছদ্মনামে ইংরেজিতে The Indigo Planting Mirror নামে এটি অনুবাদ করেন। নাটকটিকে 'Uncle Tom's Cabin'- এর সাথে তুলনা করা হয়। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: গোলক বসু, নবীন মাধব, তোরাপ, রাইচরণ, সাবিত্রী।
প্র. দীনবন্ধু মিত্রের কাব্যগুলো কী কী?
উ. 'সুরধুনী কাব্য' (১ম ভাগ- ১৮৭১, ২য় ভাগ- ১৮৭৬), 'দ্বাদশ কবিতা' (১৮৭২)। কাব্যটিতে হিমালয় থেকে গঙ্গাদেবীর সাগরসঙ্গমে যাত্রার ছন্দবদ্ধ বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে।
প্র. দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসনগুলো কী কী?
উ. 'সধবার একাদশী' (১৮৬৬): এটি নব্য ইংরেজি শিক্ষিত যুবকদের মদ্যপান ও বারবনিতা সঙ্গকে ব্যঙ্গ করে রচিত। এতে তিনটি অঙ্ক আছে।
'বিয়ে পাগলা বুড়ো' (১৮৬৬): প্রহসনটি ১৮৭২ সালে প্রথম অভিনীত হয়। এটি সমাজের প্রাচীনপন্থীদের ব্যঙ্গ করে রচিত। এ প্রহসনে বিবাহবাতিকগ্রস্ত এক বৃদ্ধের নকল বিয়ের আয়োজন করে স্কুলের অপরিপক্ক ছেলেরা কিভাবে তাকে নাস্তানুবাদ করে, সে কাহিনীই এ প্রহসনের বিষয়। চরিত্র: নসিরাম, রতা, রাজীব, রাজমণি, কেশব, বৈকুণ্ঠ।
নীলদর্পণ (নাটক) | দীনবন্ধু মিত্র |
নীলদংশন (উপন্যাস) | সৈয়দ শামসুল হক |
নীললোহিত (গল্প) | প্রমথ চৌধুরী |
প্র. 'সধবার একাদশী' সম্পর্কে আলোচনা করুন। (৩২/১৩তম বিসিএস লিখিত।
উ. দীনবন্ধু মিত্রের শ্রেষ্ঠ প্রহসন 'সধবার একাদশী' (১৮৬৬)। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মদ্যপান ও বারবনিতায় নিমজ্জিত একশ্রেণীর নব্য ইংরেজি শিক্ষিত যুবকদের জীবনে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, তাই এ প্রহসনের মূল বিষয়। নায়ক নিমচাঁদের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থতা, অধঃপতনবোধ ও আত্মগ্লানি নাটকটিতে এক গভীর মাত্রা যোজন করেছে। চরিত্রসৃষ্টি, সংলাপ, ঘটনাপ্রবাহ, কৌতুক সবকিছুর মিলিতরূপে 'সধবার একাদশী' বাংলা সাহিত্যের একটি স্মরণীয় রচনা। লেখক কেনারাম চরিত্রের মাধ্যমে তৎকালীন শিক্ষিত শ্রেণির নৈতিক অবস্থান ও বিচার ব্যবস্থার হাস্যকর পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন। চরিত্র: নিমচাঁদ, কেনারাম, জীবনচন্দ্র, গিন্নী, কাঞ্চন, অটলবিহারী, সৌদামিনী।
প্র. দীনবন্ধু মিত্রের গল্প দুটি কী কী?
উ. 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' (১২৭৯), 'পোড়া মহেশ্বর' (১২৭৯)।