কবিদের / পদকর্তাদের নাম:
আর্যদেবপা, কভাপা, কম্বলাম্বরপা, কাহ্নপা, কুকুরীপা, গুণ্ডরীপা, চাটিলপা, জয়নন্দীপা, ঢেগুণপা, ডোম্বীপা, তান্তীপা, তাড়কপা, দারিকপা, ধর্মপা, বিরূপা, বীণাপা, ভাদেপা, ভুসুকুপা, মহীণ্ডাপা, লাড়িডোম্বীপা, লুইপা, শবরপা, শান্তিপা, সরহপা।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর
প্র. চর্যাপদের মোট পদ কতটি ও কয়টি পাওয়া গেছে?
উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর 'Buddhist Mystic Songs' গ্রন্থের মতে, পদ সংখ্যা ৫০টি এবং প্রাপ্ত পদ সাড়ে ছেচল্লিশটি। ড. সুকুমার সেনের 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থের মতে, পদ সংখ্যা ৫১টি।
প্র. চর্যাপদের কোন কোন পদ পাওয়া যায়নি।
উ. ২৩ নং অর্ধেক, ২৪, ২৫ ও ৪৮ নং পদ।
প্র. যেসব পদ পাওয়া যায়নি সেগুলোর রচয়িতা কে?
উ. ২৩- ভুসুকুপা, ২৪- কাহ্নপা, ২৫- তান্তীপা, ৪৮- কুকুরীপা।
প্র. চর্যাপদের সবচেয়ে বেশি পদের রচয়িতা কে?
উ. কাহ্নপা। তিনি ১৩টি পদ রচনা করেন। যথা: ৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ২৪ (পাওয়া যায় নি), ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫। চর্যার পদকর্তাদের নামের শেষে সম্মানসূচক 'পা' যুক্ত হয়েছে। চর্যায় যারা পদ রচনা করেছেন তাদের প্রত্যেককে 'মহাসিদ্ধ' বলা হয়ে থাকে।
প্র. চর্যাপদের প্রথম পদের রচয়িতা কে?
উ. লুইপা। তিনি ২টি পদ রচনা করেন। যথা: ১, ২৯। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তিনি রাঢ় অঞ্চলের বাঙালি কবি হিসেবে পরিচিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, তিনি শবরপার শিষ্য ছিলেন। লুইপাকে আদি চর্যাকার হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
প্র. চর্যাপদের প্রথম পদটি কী?
উ. কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল / চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।
প্র. চর্যাপদ কোন ছন্দে লেখা?
উ. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।
প্র. কোন পণ্ডিত চর্যাপদের পদগুলোকে টীকার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন?
উ. মুনিদত্ত। মুনিদত্ত ১১ নং পদের ব্যাখ্যা প্রদান করেননি।
প্র. চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদ কে আবিষ্কার করেন?
উ. চর্যাপদ তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন কীর্তিচন্দ্র। ১৯৩৮ সালে প্রবোধচন্দ্র বাগচী এটি আবিষ্কার করেন।
প্র. চর্যাপদের অন্যান্য পদকর্তাগণ কে কতটি পদ রচনা করেন?
পদকর্তার নাম | সংখ্যা | অবশিষ্ট পদকর্তাগণ ১টি করে পদ রচনা করেন। লাড়ীডোম্বী পা'র নাম পাওয়া গেলেও তাঁর কোন পদ পাওয়া যায়নি। |
ভুসুকু পা (বাঙালি কবি) | ৮ | |
সরহ পা | ৪ | |
কুকুরী পা (মহিলা কবি) | ৩ | |
লুই পা, শবর পা, শান্তি পা | ২ |
প্র. চর্যাপদের প্রবাদ বাক্য কয়টি ও কী কী?
উ. ৬টি। যথা:
প্র. প্রাচীনতম ও আধুনিকতম চর্যাকার কে?
উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, প্রাচীনতম শবর পা (৬৮০-৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং আধুনিকতম ভুসুকুপা। শবরপা, ভুসুকুপা ও লুইপা বাঙালি কবি হিসেবে পরিচিত।
প্র. কাহ্নপার পরিচয় দাও। (১৩/১০৯ম বিসিএস লিখিত)
উ. চর্যাপদের সবচেয়ে বেশি পদের রচয়িতা কাহ্নপা। তিনি ১৩টি পদ রচনা করেন। কাহ্নপা সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধযোগী। তিনি ধর্মশাস্ত্র ও সংগীত শাস্ত্র উভয় বিষয়েই দক্ষ ছিলেন। তাঁর পদগুলোতে নিপুণ কবিত্বশক্তি প্রকাশের পাশাপাশি তৎকালীন সমাজচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে।
প্র. চর্যাপদের ভাষা কোনটি?
উ. মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বা আলো-আঁধারির ভাষা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, এর ভাষার নাম 'বঙ্গকামরূপী'। এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।
প্র. সন্ধ্যা ভাষা কী? এ ভাষায় রচিত সাহিত্য সম্পর্কে লিখুন। (৪০তম, ৩৮তম ও ৩২তম বিসিএস লিখিত)
উ. যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায়নি, যে ভাষার অর্থ একাধিক অর্থাৎ আলো-আঁধারের মতো, সে ভাষাকে পণ্ডিতগণ সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বলেছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন 'চর্যাগীতি' বা 'চর্যাপদ' এ ভাষায় রচিত। 'চর্যাগীতি' বা 'চর্যাপদ' গানের সংকলন বা সাধন সংগীত যা বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচনা করেন। সন্ধ্যা ভাষা সম্পর্কে চর্যাপদের আবিষ্কারক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, 'আলো-আঁধারির ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না'।
প্র. চর্যাপদের ভাষা নিয়ে কে আলোচনা করেন?
উ. ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় The Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) (১৯২৬) গ্রন্থে।
প্র. চর্যাপদের ধর্মমত নিয়ে কে আলোচনা করেন?
উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ Buddhist Mystic Songs' গ্রন্থে।
প্র. চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে ধারণা দিন। (২৯তম বিসিএস লিখিত)
উ. বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। চর্যাগীতি বা চর্যাপদ গানের/কবিতার সংকলন বা সাধন সংগীত যা বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচনা করেন।এতে বিধৃত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বকথা। এগুলো মূলত মহাজ্ঞান ধর্মশাখার অন্তর্গত সহজযান ধর্মশাখার সাধনসংগীত। বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখা কালক্রমে যেসব উপশাখায় বিভক্ত হয়েছিল তারই বজ্রযানের সাধনপ্রণালী ও তত্ত্ব চর্যাপদে বিধৃত। 'মহাসুখরূপ নির্বাণ লাভ' হলো চর্যার প্রধান তত্ত্ব। এ সম্পর্কে চর্যাকার ভুসুকুপা বলেছেন, 'সহজানন্দ মহাসুহ লীলে'। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের মূলগত ভাবনার অনুসারী হলেও এখানে প্রাধান্য লাভ করেছে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম।
প্র. চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কিত বিতর্কের ব্যাখ্যা দাও। [৪৩/৩৫/২৮তম বিসিএস লিখিত]
উ. বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' বা 'চর্যাগীতিকোষ' বা 'চর্যাগীতি' বা 'চর্যাপদ'। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার (রয়েল লাইব্রেরি) থেকে এটি আবিষ্কার করেন। শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) কলকাতার 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' থেকে 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়', 'ডাকার্ণব' ও 'সরহপাদের দোহা' ও 'কৃষ্ণপাদের দোহা' গ্রন্থের সম্মিলন 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা' নামে প্রকাশিত হয়।
এটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক শুরু হয় এর ভাষা নিয়ে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী 'চর্যাপদ' গ্রন্থটিকে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কারক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ তাঁর এ দাবিকে সমর্থন করেন।
১৯২০ সালে বিজয়চন্দ্র মজুমদার History of the Bengali Language গ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষাকে প্রাচীন বাংলা বলতে অস্বীকার করেন। এছাড়াও হিন্দি, অসমিয়া, ওড়িয়া প্রভৃতি ভাষাবিদরা নিজ নিজ ভাষার আদি নিদর্শন বলে দাবি করেন।
১৯২৬ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) (১৯২৬) গ্রন্থে চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ এবং চর্যার কবিদের নাম, পদ্মা নদীর নামের উল্লেখ (ভুসুকুপার ৪৯ নং পদে 'পউয়া খাল') বিশ্লেষণ করে এর ভাষাকে প্রাচীন বাংলার আদি নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৯২৭ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্যারিস থেকে প্রকাশিত 'Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha' গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতকে সমর্থন করেন। তাঁর মতে, এর ভাষার নাম বঙ্গকামরূপী।
তারপরও সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমরা বলতে পারি যে, এটি সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বা আলো-আঁধারির ভাষায় এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।
প্র. নবচর্যাপদ কী?
উ. 'নবচর্যাপদ' চর্যাপদের অনুরূপ রচনা। শশীভূষণ দাশগুপ্ত ১৯৬৩ সালে নেপাল ও তরাইভূমি থেকে ২৫০টি পদ আবিষ্কার ও সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে ১০০টি পদ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীতে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৮৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'নবচর্যাপদ' নামে সেগুলোর মধ্য থেকে ৯৮টি পদ সংকলন করে প্রকাশ করেন। এ পদগুলোর রচনাকাল বারো থেকে ষোলো শতকের মধ্যে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্র. নতুন চর্যাপদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উ. বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা নিরন্তর চলমান। প্রাচীন যুগের একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ প্রকাশের ১০০ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও ফোকলোর বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ চর্যাপদ গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত চর্যাপদের নাম 'নতুন চর্যাপদ'। নতুন চর্যাপদ মূলত বজ্রযানী দেবদেবীর আরাধনার গীত। এর পদগুলোতে তান্ত্রিক নানা দেবদেবীর রূপসৌন্দর্য, মুখ ও বাহুর বর্ণনা, তাঁদের আসন, মুদ্রা ও দেহভঙ্গি, তাঁদের আভরণ ও আয়ুধ ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য ও বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। এটি ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলায় প্রকাশিত হয় এবং উৎসর্গ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে। ২০০৮ সালে ড. শাহেদ কাঠমুন্ডু ও আশেপাশের বিভিন্ন বজ্রযানী মন্দিরে পুঁথি সংগ্রহ করতে গিয়ে রত্নকাজী বজ্রাচার্যের নিকট থেকে নতুন চর্যাপদের দুটি সংকলিত পুস্তক সংগ্রহ করেন। এ পুস্তক দুটির পদগুলো ছিলো নেওয়ারিমিশ্রিত দেবনাগরী অক্ষরে মুদ্রিত। নতুন চর্যাপদে যেসব পদ সংকলিত হয়েছে সেগুলোর রচনাকাল অষ্টম থেকে বিশ শতক পর্যন্ত। সুতরাং নতুন এই চর্যাপদ প্রমাণ করে যে, চর্যাপদ কেবল প্রাচীন সাহিত্যেরই নিদর্শন নয়, মধ্যযুগেও এগুলোর রচনা অব্যাহত ছিল। এমনকি বিশ শতকেও চর্যাপদ রচিত হয়েছে। সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ সংকলিত ও সম্পাদিত নতুন চর্যাপদে ৩৩৫টি পদ সংকলিত হয়েছে। এছাড়া পরিশিষ্ট অংশে রাহুল সাংকৃত্যায়ন সংগৃহীত ২০টি, শশিভূষণ দাশগুপ্ত সংগৃহীত ২১টি এবং জগন্নাথ উপাধ্যায় সংগৃহীত ৩৭টি পদ সংকলিত হয়েছে। সে হিসেবে এ গ্রন্থে সংকলিত নতুন চর্যাপদের মোট সংখ্যা ৪১৩টি। নতুন চর্যাপদের ভূমিকা অংশটি চার ভাগে বিভক্ত।