বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ
বাংলার আদিম অধিবাসীগণ প্রথম থেকেই বাংলায় কথা বলেনি। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম ভাষা হিসেবে বাঙলা বিবর্তিত হয়েছে বলে প্রাক-আর্য যুগের অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষার সাথে বাংলার সংশ্লিষ্টতা নেই। বাংলার আদিম অধিবাসীদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক। অনার্যদের তাড়িয়ে আর্যরা এদেশে বসবাস শুরু করলে তাদেরই আর্য ভাষা হতে বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। অতএব বলা যায় যে, বাঙালি জাতি যেমন সংকর জাতি তেমনি বাংলা ভাষাও সংকরায়ণের মাধ্যমে সৃষ্টি। হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ 'বেদ' এর ভাষা হল বৈদিক ভাষা। দেবদেবীর পূজা এবং বৈদিক যজ্ঞকার্যে ব্যবহার করা এ ভাষা কালক্রমে উচ্চারণের অপপ্রয়োগ, বিকৃতি এবং স্থানীয় শব্দাবলির সংযোজনের কারণে কৌলিন্য হারিয়ে ক্রমেই অপ্রচলিত হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের বিখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিনি বৈদিক ভাষার সংস্কার সাধন করেন এবং নির্দিষ্ট সূত্র প্রদান করেন। সংস্কারকৃত এ নির্দিষ্ট ভাষাই সংস্কৃত ভাষা। সংস্কৃত ভাষা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল না, এ ভাষা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা ব্যবহার করতেন।
সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল 'প্রাকৃত ভাষা'। 'প্রাকৃত' শব্দের অর্থ 'স্বাভাবিক'। পরবর্তীতে প্রাকৃত ভাষা থেকে 'পালি' ও 'অপভ্রংশ' নামক দুটি ভাষার উদ্ভব ঘটে। সাধুভাষা থেকে ভ্রষ্ট কিংবা বিকৃতভাবে উচ্চারিত শব্দই অপভ্রংশ। বৈয়াকরণ পতঞ্জলির মতে, 'বিশেষ ভাষার বিচ্যুত বা বিকৃত ভাবই অপভ্রংশ'। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অপভ্রংশের বিস্তারকাল ধরা হয়। বাংলা ভাষা অপভ্রংশের নিকট ঋণী। 'প্রাকৃত' ভাষার প্রকারভেদ ঘটলেও সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা প্রাকৃতই থেকে গেল। পরবর্তীতে 'প্রাকৃত' ভাষাই ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রভাবে, কথ্য ভাষার উচ্চারণের বিভিন্নতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করল। কালক্রমে 'প্রাকৃত' থেকে উৎপত্তি লাভ করে 'বাংলা ভাষা'।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন - উত্তর
প্র. ভাষা কাকে বলে?
উ. মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম ভাষা। মানুষের মুখে উচ্চারিত অর্থবোধক ও মনোভাব প্রকাশক ধ্বনিসমষ্টিকে ভাষা বলে। ভাষার মূল উপাদান ধ্বনি।
প্র. বাংলার আদি অধিবাসিগণ কোন ভাষাভাষী ছিল?
উ. অস্ট্রিক।
প্র. বাংলা ভাষার উৎপত্তি কবে?
উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, সপ্তম শতাব্দী।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, দশম শতাব্দী।
প্র. কোন ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি?
উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, গৌড়ী প্রাকৃত থেকে।
জর্জ গ্রিয়ারসন ও ড. সুনীতিকুমারের মতে, মাগধী প্রাকৃত থেকে।
প্র. বাংলা ভাষার মূল উৎস কী?
উ. প্রাকৃত ভাষা।
প্র. 'ইন্দো-ইউরোপীয়' ভাষা কাকে বলে?
উ. পৃথিবীর সমস্ত ভাষাকে কয়েকটি ভাষাবৃক্ষে বিভক্ত করা যায়। এ ভাষাবৃক্ষগুলোর মূলভাষার একটি ইন্দো-ইউরোপীয়। এ নামটি কাল্পনিক। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইউরোপ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সব ভাষাকে এই ভাষাবংশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষার উদ্ভব বলে ধারণা করা হয়।
প্র. ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের শাখা কয়টি?
উ. দুইটি। যথা: কেন্তুম ও শতম। এ দুটি শাখার উপশাখা রয়েছে ৮টি। যথা: গ্রিক, ইতালিক, কেলটিক, জার্মানিক, আর্য (ইন্দো-ইরানীয়), বাল্টো-স্লাভিক, আর্মেনীয় ও আলবেনীয়। এর প্রথম চারটি কেন্তুম শাখার, শেষের চারটি শতম শাখার অন্তর্ভুক্ত। ইউরোপীয় ভাষাগুলোকে কেন্তুম ও আর্য (ইন্দো-ইরানীয়) ভাষাগুলোকে শতম শাখা ধরা হয়। বাংলা ভাষার উদ্ভব ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার শতম শাখা থেকে।
প্র. 'অপভ্রংশ' কী?
উ. সাধুভাষা থেকে ভ্রষ্ট কিংবা বিকৃতভাবে উচ্চারিত শব্দই অপভ্রংশ। বৈয়াকরণ পতঞ্জলির মতে, 'বিশেষ ভাষার বিচ্যুত বা বিকৃত ভাবই অপভ্রংশ'। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অপভ্রংশের বিস্তারকাল ধরা হয়।
প্র. 'সংস্কৃত' ভাষা কী?
উ. হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ 'বেদ' এর ভাষা হল বৈদিক ভাষা। দেবদেবীর পূজা এবং বৈদিক যজ্ঞকার্যে ব্যবহার করা এ ভাষা কালক্রমে উচ্চারণের অপপ্রয়োগ, বিকৃতি এবং স্থানীয় শব্দাবলির সংযোজনের কারণে কৌলিন্য হারিয়ে ক্রমেই অপ্রচলিত হতে থাকে। সপ্তম শতকের বিখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিনি বৈদিক ভাষার সংস্কার সাধন করেন এবং নির্দিষ্ট সূত্র প্রদান করেন। সংস্কারকৃত এ নির্দিষ্ট ভাষাই সংস্কৃত ভাষা।
প্র. বাংলা ভাষার আদি স্তরের স্থিতিকাল কত?
উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। ড. সুনীতিকুমারের মতে, দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী।
প্র. বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত ভাষা কতটি?
উ. প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
প্র. 'ঋগ্বেদ' সম্পর্কে কী জান?
উ. 'ঋগ্বেদ' ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় রচিত প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোর অন্যতম। এটি প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত স্তোত্র সংকলন। এর রচয়িতা হিসেবে ৩৭৮ জনের নাম পাওয়া যায়, যার মধ্যে ৩৫০ জন ঋষি এবং ২৮ জন ঋষিকা। এটি ৭টি মৌলিক ছন্দ এবং প্রায় ৪০টি মিশ্র ছন্দে রচিত। এর সংকলক পরাশপুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।
পৃথিবীর ভাষাগুলোকে ইন্দো-ইউরোপীয়, চীনা-তিব্বতীয়, আফ্রিকীয়, সেমীয়-হেমীয়, দ্রাবিড়ীয়, অস্ট্রো-এশীয় প্রভৃতি ভাষা পরিবারে ভাগ করা হয়ে থাকে। ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, হিস্পানি, রুশ, পর্তুগিজ, ফারসি, হিন্দি, উর্দু, নেপালি, সিংহলি প্রভৃতি ভাষার মতো বাংলা ভাষাও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য। এ পরিবারের আদি ভাষা বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় পরিণত হয়েছে।
বিবর্তন স্তর: ইন্দো-ইউরোপীয় → ইন্দো-ইরানীয় → ভারতীয় আর্য → প্রাকৃত → বাংলা। আনুমানিক এক হাজার বছর পূর্বে ভারতীয় প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। বাংলা ভাষার লিখিত রূপের প্রাচীনতম নিদর্শন 'চর্যাপদ'।