আরব বসন্ত

আরব বসন্ত (Arab Spring)

২০১০ এর দশকের প্রথমার্ধে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বয়ে যাওয়া গণবিপ্লবের ঝড় 'আরব বসন্ত' নামে পরিচিত। পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ন্যায় বিচার না পেয়ে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ার তরুণ সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি প্রকাশ্যে নিজ শরীরে আগুন জ্বেলে আত্মাহুতি দেন। এ ঘটনা থেকে জন্ম আরব বসন্তের। ঐ যুবকের আত্মাহুতির খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তিউনিসিয়ার মানুষ শুরু করে আন্দোলন। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৪ জানুয়ারি, ২০১১ পদত্যাগে বাধ্য হন দেশটির প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেন আলী। বিদ্রোহের এই আগুন আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মিশর, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, লিবিয়াসহ সমগ্র আরব অঞ্চল উত্তাল হয়ে ওঠে।

মিশর: তিউনিসিয়ায় বিপ্লবের সফল পরিণতি উজ্জীবিত করে হোসনি মোবারকের স্বৈরশাসনে নিষ্পেষিত মিশরের সাধারণ মানুষকে। কায়রোর তাহরির স্কয়ার পরিণত হয় মুক্তিকামী মানুষের জনসমুদ্রে। প্রচণ্ড গণ আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের ইতি ঘটে। ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১১ মুবারক ক্ষমতা ছেড়ে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় আসে মুসলিম ব্রাদারহুড। মুহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক বছর শাসন পরিচালনার পর সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়। ফলে মিশরে আবার জনগণের স্বাধীনতা খর্ব হয়।

লিবিয়া: লিবিয়ায় প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সেখানে বিক্ষোভ ছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের মদদে। তাদের সহযোগিতায় বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির দীর্ঘ ৪২ বছরের শাসনের অবসান ঘটায় বিদ্রোহীরা। গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ প্রথম শুরু হয় দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে। মিসরাতায় গাদ্দাফি বিরোধী ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই হয়। আগস্ট, ২০১১ বিদ্রোহীরা রাজধানী ত্রিপলিতে ঢুকে পড়ে। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত 'গ্রিন স্কোয়ার' অধিকার করে নেয় এবং ঐ স্কয়ারের নতুন নাম দেয় 'শহীদ চতুর'। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর 'সিরত্' শহরে বিদ্রোহীদের হাতে আটক হয়ে নির্মমভাবে নিহত হন গাদ্দাফি। 

সিরিয়া: সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ সিরিয়া ১৯৭০ সাল থেকে শাসন করছে সংখ্যালঘু আলওয়াইটস গোত্রের (শিয়াদের একটি উপদল) বাশার আল আসাদ এর পরিবার। আরব বসন্তে উজ্জীবিত হয়ে সিরিয়ার গণতন্ত্রপন্থীরা ২০১১ সালের মার্চে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করে। বাশার আল আসাদ এর নেতৃত্বাধীন আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি'র সরকার বিক্ষোভ দমনে রক্তক্ষয়ের পথ বেছে নেয়।ি এতে প্রতিবাদ আরও ছড়িয়ে পড়ে যা একপর্যায়ে দেশজুড়ে ক প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়। অস্ত্র হাতে তুলে নেয় বিরোধীরা। ২০১১ সালের জুলাইয়ে বেসামরিক জনগণ ও সেনাবাহিনীর দলত্যাগী সৈন্যরা 'ফ্রি সিরিয়ান আর্মি' নামে বিদ্রোহী যোদ্ধা দল গঠন করে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। শুরুতে এই যুদ্ধ ছিল কেবল প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব এতে নাক গলিয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তোলে। বিদ্রোহীদের রসদ যোগায় যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও সৌদি আরব। অন্যদিকে বাশার আল- আসাদ সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয় রাশিয়া ও ইরান। রুশ সামরিক বাহিনী বাশার আল-আসাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মার্কিন মদদপুষ্ঠ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে। এর মধ্যে আবার উত্থান ঘটে ইসলামি সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ISIS (Islamic State in Iraq and Syria) বা সংক্ষেপে IS (Islamic State) এর। সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল একটি অঞ্চল দখলে নিয়ে সিরিয়ার রাকাকে রাজধানী করে ২০১৪ সালে আলাদা খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় আইএস। আইএস এর বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। ২০১৭ সালে খিলাফত রাষ্ট্রটির পতন ঘটে। সব মিলিয়ে গভীর জটাজালে ঘুরপাক খায় সিরিয়া। যুদ্ধের কারণে দামেস্ক (বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর), আলেপ্পো,ইদলিব,পালমিরাসহ,সিরিয়ার অনেক শহর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় সিরিয়ার প্রায় অর্ধেক মানুষ। জীবন বাঁচাতে শরণার্থীরা  ইউরোপকে শেষ আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়। ফলে ইউরোপজুড়ে অভিবাসী সংকট দেখা দেয়।

ইয়েমেন: ১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একত্রীকরণের মাধ্যমে ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র আত্মপ্রকাশ করে। সেই থেকে ইয়েমেনের ক্ষমতায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ। আরব বসন্তের ঢেউ ইয়েমেনে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় নেয়নি। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট সালেহ তার ডেপুটি আবদারাবুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন। প্রেসিডেন্ট হাদিকে আল কায়েদার হামলা, দক্ষিণে বিছিন্নতাবাদী আন্দোলনসহ অনেকগুলো সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। নতুন প্রেসিডেন্টের দুর্বলতার সুযোগে ইয়েমেনের জাইদি শিয়া মুসলিম নেতৃত্বের হুতি বিদ্রোহীরা (আনুষ্ঠানিক নাম 'আনসার আল্লাহ') দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকা দখলে নিয়ে সানায় নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করে। হুতিদের সমর্থন দেয় ইরান। অন্যদিকে, হাদিকে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে সৌদি আরবসহ কয়েকটি সুন্নি দেশ একজোট হয়ে ইয়েমেনে অভিযান শুরু করে। এই জোটকে লজিস্টিক আর ইন্টেলিজেন্স সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স। 

Reference: জর্জ MP3 আন্তর্জা‌তিক