ইউরোপে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ
একটি ভৌগোলিক এলাকায় বসবাসকারী কোনো জনগোষ্ঠী যখন নিজেদেরকে এক ভাবে এবং অন্য জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা মনে করে তখন তারা জাতীয়তা গঠন করে। ঐক্যানুভূতি জাতীয়তা গঠনে অপরিহার্য। জাতীয়তার বাহ্যিক উপাদানগুলো হল অভিন্ন ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভৌগোলিক এলাকা প্রভৃতি। তবে উপাদানগুলো জাতীয়তা গঠনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়। কেননা জাতীয়তা মূলত একটি মানসিক ব্যাপার। জাতীয়তা তখনই জাতিতে পরিণত হয় যখন তা রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বা স্বাধীনতা লাভে আগ্রহী। হয়। জাতির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা প্রবল। গিল ক্রাইস্টের মতে, 'জাতি হলো রাষ্ট্রের অধীনে সুসংগঠিত একটি জনসমাজ'। জাতীয়তার ভিত্তিতে সৃষ্ট রাষ্ট্রই জাতি রাষ্ট্র। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো মূলত জাতি রাষ্ট্র। ইতালীয় রাষ্ট্র দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলিকে জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা মনে করা হয়।
মধ্যযুগের ইউরোপে কোনো আলাদা রাষ্ট্র ছিল না। সমগ্র ইউরোপ ছিল পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য দাঁড়িয়ে ছিল সামন্তবাদী আর্থ-সামাজিক কাঠামোর উপর। দশম শতকে ফ্রান্সে সামন্তবাদ পদ্ধতির সূত্রপাত হয়। এবং ক্রমে তা ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। চতুর্দশ শতকের শেষদিক থেকে এই সামন্ত কাঠামো ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দী থেকে সমগ্র ইউরোপে বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজা ও জমিদারগণ অনেকটা স্বাধীন হয়ে পড়ে। এ সময় ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টটান্টদের বিরোধকে কেন্দ্র করে ইউরোপে ভয়ানক একটি যুদ্ধ হয়। প্রথম দিকে এই যুদ্ধটি খ্রিষ্টধর্মের দু'টো সম্প্রদায়ের বিরোধকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও তা কালক্রমে ইউরোপের তৎকালীন ছোট বড় প্রায় সকল রাজ্য ও রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে ছিল। ৩০ বছরব্যাপী (১৬১৮ - ১৬৪৮ খ্রি.) অবিরামভাবে যুদ্ধ করার পর ক্লান্ত বিপর্যস্ত ইউরোপ ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টাফেলিয়া চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে -এই যুদ্ধের অবসান ঘটায়। এই সন্ধি ইউরোপে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে। রেনেসাঁসের প্রভাবে ক্রমে পরিবর্তির সামাজিক পরিস্থিতি এবং জ্ঞান ও মননের বিকাশের পটভূমিতে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আঠারো এবং উনিশ শতকে আধুনিক জাতীয়তাবাদ ইউরোপে আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের বিকাশের গতিকে ত্বরান্বিত করে। ইউরোপে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে ছিল স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি অঞ্চলসমূহ ।