গ্রিক সভ্যতা

গ্রিক সভ্যতা (The Greek Civilization)

ভৌগোলিক অবস্থান: ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কারণে গ্রিক সভ্যতার সাথে দুইটি সংস্কৃতির নাম জড়িয়ে আছে। একটি 'হেলেনিক' (Hellenic) এবং অন্যটি 'হেলেনিস্টিক' (Hellenistic)। গ্রিক উপদ্বীপের প্রধান শহর এথেন্সকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে হেলেনিক সংস্কৃতি। অন্যদিকে, গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াকে কেন্দ্র করে গ্রিক সংস্কৃতি ও অগ্রিক সংস্কৃতির মিশ্রণে নতুন 'হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি'র জন্ম হয়।

গ্রিস দেশটি অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, ভূমধ্যসাগর ও ইজিয়ান সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। গ্রিসের ভৌগোলিক পরিবেশ একটু ভিন্ন ধরনের। এ অঞ্চলে অনেকগুলো পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল দেয়ালের মত। প্রাচীনকালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল দেশটি। এ ছোট দেশগুলোর নাম হয় নগর রাষ্ট্র। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিল স্পোর্টা ও এথেন্স। এথেন্স ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এথেন্সে রাষ্ট্র পরিচালনায় তখন দুইটি সংসদ ছিল। গোত্র প্রধানদের নিয়ে গড়া সংসদকে বলা হত 'এরিওপেগাস' এবং সাধারণ নাগরিকদের সমিতিকে বলা হত 'একলেসিয়া'। এথেন্সে চূড়ান্তভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন পেরিক্লিস্। পেরিক্লিস এথেন্সের ক্ষমতায় আসেন ৪৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। পক্ষান্তরে প্রতিবেশী স্পার্টা  ছিল একটি সামরিক নগর রাষ্ট্র। রাষ্ট্রনেতারা ছিল স্বৈরাচারী ।স্পার্টা ও এথেন্স উভয় দেশ একে অন্যের শত্রু ছিল। এথেন্স তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি জোট গঠন করে। এর নাম হয় 'ডেলিয়ান লীগ'। অন্যদিকে স্পার্টা তাঁর বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে গঠন করে আরেকটি জোট। এ জোটের নাম হয় 'পেলোপনেসীয় লীগ'। এক সময় এই দুই জোটের মধ্য যুদ্ধ বেধে যায়। ইতিহাসে এ যুদ্ধ 'পেলোপনেসীয় যুদ্ধ' নামে পরিচিত। ৪৬০ - 808 খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মোট ৩ বার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে চূড়ান্ত পতন ঘটে এথেন্সের। ৩৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্স চলে আসে স্পার্টার অধীনে। এরপর নগররাষ্ট্র থিবস দখল করে নেয় এথেন্স। ৩৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপস থিবস অধিকার করে নেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৬ অব্দে দ্বিতীয় ফিলিপসের মৃত্যু হলে তার ছেলে আলেকজান্ডার ম্যাসিডনের সিংহাসনে আরোহণ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে ব্যাবিলনে তাঁর মৃত্যু হয়।

ধর্ম: গ্রিকদের বারটি দেব-দেবী ছিল। জিউস ছিলেন দেবতাদের রাজা। দেবতা এপোলো ও দেবী এথেনাও ছিলেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিকবাসী বিশ্বাস করত দেবতাদের বাস উত্তর গ্রিসে অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায়।

 গ্রিক পুরাণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হল ট্রয়ের যুদ্ধ। অনেকে ভাবতেন, ট্রয় নগরী বা ট্রয়ের যুদ্ধ- উভয়ই বিষয়ই নিছক গল্পগাঁথা। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকগণ তুরস্কের হিসার্লিক অঞ্চলে ট্রয় নগরী খুঁজে পান।

 

গ্রিক দেবী বা দেবতাপরিচিতি
জিউস (Zeus)দেবতাদের রাজা
হেরা (Hera)বিবাহ বন্ধন অটুট রাখার দেবী। জিউসের স্ত্রী
এরিস (Ares)যুদ্ধদেবতা
আফ্রোডিটি (Aphrodite)ভালবাসা, রোমাঞ্চ এবং সৌন্দর্যের দেবী
এরোস (Eros)ভালবাসা ও রোমাঞ্চের দেবতা
অ্যাপোলো (Apollo)সূর্য, আলো, চিকিৎসাবিদ্যা এবং সঙ্গীতের দেবতা
আরটেমিস (Artemis)শিকার, বন, উর্বরতা এবং চাঁদের দেবী
এথেনা (Athena)প্রজ্ঞার দেবী (জিউসের কন্যা)
ডিমিটার (Demeter)কৃষি বিষয়ক দেবী
হারমেস (Hermes)ব্যবসা বিষয়ক দেবতা (রোমান নাম মারকারি)
নিকে (Nike)বিজয়ের দেবী (Goddess of victory)

 

দর্শন: গ্রিকদের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল দর্শন চর্চায়। প্রথম দিকের বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন থ্যালেস। থ্যালেস কল্পকাহিনীর বদলে প্রথম সূর্যগ্রহণের প্রাকৃতিক কারণ ব্যাখ্যা করেন। ধীরে ধীরে গ্রিসে এক ধরনের যুক্তিবাদী দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। এঁদের বলা হতো সফিস্ট। প্রোতাগোরাস ছিলেন সফিস্ট সম্প্রদায়ের সবচেয়ে প্রাচীন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক। সৃষ্টির অজানা রহস্য নয়, বরং মানুষকে মানদণ্ড বিবেচনা করে সে আলোকে দর্শনের আলোচনা ও ভাষাবিজ্ঞানে অবদানের জন্য সুবিখ্যাত হয়ে। আছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, 'Man is the measure of all things'

 

SocratesPlatoAristotle
শিক্ষকছাত্রছাত্র
শিক্ষক

সক্রেটিস ছিলেন গ্রিসের দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান। অন্যায় শাসনের প্রতিবাদ করায় গ্রিসের শাসক গোষ্ঠী ৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এ মহান দার্শনিককে হেমলক (গুলাজাতীয় গাছ) লতার তৈরি বিষ খাইয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর শেষ বাক্য ছিল, 'Crito, I owe a cock to Asclepius, will you remember to pay the debt?" ("ক্রিটো, অ্যাসক্লেপিয়াস আমার কাছে একটি মোরগ পায়, তার ঋণ পরিশোধ করতে ভুলো না যেন")। অ্যাসক্লেপিয়াস হচ্ছে গ্রিকদের আরোগ্য লাভের দেবতা। সক্রেটিসের শেষকথা থেকে বোঝা যায়, তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন মৃত্যু হলো আরোগ্য এবং দেহ থেকে আত্মার মুক্তি।

সক্রেটিসকে 'সব জ্ঞানীদের গুরু' বলা হয়।

সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি-

-Know thyself. (নিজেকে জানো)

-Slanderers do not hurt me because they do not hit me.

-I to die, you to live- which is the better only God knows.

-An unexamined life is not worth living

-Virtue is knowledge (সৎগুণই জ্ঞান)

সক্রেটিসের ছাত্র দার্শনিক প্লেটো গ্রিক দর্শনকে চরম উন্নতির দিকে নিয়ে যান। তিনি তাঁর চিন্তাগুলো ধরে রাখেন দি রিপাবলিক' নামক গ্রন্থ রচনা করে। এই গ্রন্থে প্লেটো দার্শনিক রাজা শাসিত 'আদর্শ রাষ্ট্রের' কল্পনা করেছিলেন। প্লেটো ৩৮৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দর্শনের স্কুল 'Academia' প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সক্রেটিসের শিক্ষার বক্তব্যগুলো নিয়ে 'ডায়ালগস অব সক্রেটিস' নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। প্লেটোর বিখ্যাত উক্তি-

-Virtue is Knowledge and Education is the main thing to acquire virtue

-Knowledge is virtue) (জ্ঞানই পূণ্য)

-শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আত্মা ও দেহের সুষম বিকাশ সাধন।

প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটলও একজন বড় দার্শনিক ছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম 'দ্যা পলিটিক্স'। তিনি 'লাইসিয়াম'- এর প্রতিষ্ঠাতা। এরিস্টটল আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক ছিলেন।

এরিস্টটলের উক্তি-

-Man is Social and Political by Nature (মানুষ স্বভাবতই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব)।

-Man without society is either a beast or a Go (যে ব্যক্তি সমাজে বাস করে না, সে হয় দেবতা না হয় পশু)।

-মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই রাজনীতির কবি)।

-বল, শক্তি এবং লোভ লালসা মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবে অসমভাবে বণ্টিত।

গ্রিক সাহিত্য: অন্ধ গ্রিক মহাকবি হোমার হাজার হাজার বছরের প্ররোনো কাহিনী নিয়ে রচনা করেন। মহাকাব্য Iliad (ইলিয়াড) এবং Odyssey (ওডিসি)। তাঁকে 'অন্ধ পাখি' বলা হয়। গ্রিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাট্যকার ছিলেন 'এস্কাইলাস'। তাঁর বিখ্যাত দুইটি নাটকের নাম 'প্রমেথিউস বাউন্ড' ও 'আগামেমনন'। নাট্যকার সফোক্লিস একশটিরও বেশি নাটক লেখেন। এর মধ্যে জনপ্রিয় দুইটি হচ্ছে 'এন্টিগনে' ও 'ইলেক্ট্রা'। নাট্যকার সফোক্লিসের বিখ্যাত ট্রাজেডি রাজা ইডিপাস'। ইউরিপিদিস ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ গ্রিক ধ্রুপদী 'নাটাকার। তাঁর আলোচিত নাটক ওরেস্তেস। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও সমান কৃতিত্ব ছিল গ্রিকদের। গ্রিক ইতিহাসবেত্তা হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয়। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'The Histories'। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে সংঘটিত গ্রিক- পারসিকদের যুদ্ধের কাহিনী এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। গ্রিসের অন্য খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ছিলেন 'খুসিডাইডিস' (Thucydides) তাঁর লেখা 'History of the Peloponnesian War' গ্রন্থ ব্যাপকভাবে সমাদৃত। খুসিডাইডিকে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসের জনক বলা হয়।

বিজ্ঞান: গ্রিক বিজ্ঞানীরা প্রথম পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। গ্রিক দার্শনিক আনাক্সিমান্ডোস সর্বপ্রথম পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন করেন। তারাই প্রথম প্রমাণ করেছিলেন যে, পৃথিবী একটি গ্রহ এবং তা নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হয়। বিখ্যাত গ্রিক গণিতবিদ 'পিথাগোরাস' খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জন্ম নিয়েছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে জন্ম নেন বিজ্ঞানী এনাক্সাগোরাস'। চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপোক্রেটিস যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

খেলাধুলা: খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে গ্রিসে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার জন্ম হয়। প্রতি চার বছর অন্তর এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রের খেলোয়াড়রা অংশ নিত।

স্থাপত্য ও ভাস্কর্য: কয়েকজন খ্যাতিমান গ্রিক ভাস্কর হচ্ছেন মাইনর, ফিদিয়াস এবং প্রাকসিটেলেস। প্রাচীন গ্রিসে মৃৎপাত্রের গায়ে চিত্রকর্ম অঙ্কন করা হতো। গ্রিক স্থাপত্যের উদাহরণ হিসেবে মন্দির পার্থেনন, এথেন্সের দেবী এথেনার মন্দির ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

অর্থনীতি: জনসমাবেশ ও বাজারের জন্য নির্ধারিত খোলাস্থানকে 'Agora' বলা হতো।

 

Reference: জর্জ MP3 আন্তর্জা‌তিক