যুগ সন্ধিক্ষণ

যুগ সন্ধিক্ষণ (১৭৬০ - ১৮৬০)

আঠারো শতকের শেষার্ধে ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রাষ্ট্রিক, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের মুখে কলকাতার হিন্দু সমাজে 'কবিওয়ালা' এবং মুসলিম সমাজে 'শায়ের' এর উদ্ভব ঘটে। ১৭৬০ সালে ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকে ১৮৬০ সালে আধুনিকতার যথার্থ বিকাশের পূর্ব পর্যন্ত এই ১০০ বছর বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে উৎকর্ষপূর্ণ কোনো নিদর্শন বিদ্যমান নেই।

 

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর

প্র. যুগ সন্ধিক্ষণ বলতে কী বোঝায়?

উ. ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের তিরোধানের মাধ্যমে মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘটে এবং ১৮৬০ সালে মাইকেলের সদর্প আগমনের মাধ্যমে আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে। এ ১০০ বছর সাহিত্য জগতে চলছিল বন্ধ্যাকাল, ফলে এ সময়টুকুকে বলে 'অবক্ষয় যুগ' বা 'যুগ সন্ধিক্ষণ'।

প্র. যুগ সন্ধিক্ষণের কবি কে?

উ. ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত।

প্র. কবে কবিওয়ালা ও শায়েরের উদ্ভব ঘটে?

উ. আঠারো শতকের শেষার্ধে ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে।

প্র. কবিগান কী? (১৮তম বিসিএস লিখিত)

উ. দুই পক্ষের মধ্যে বিতর্কের মাধ্যমে যে গান অনুষ্ঠিত হতো তাই কবিগান। দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাই এর বৈশিষ্ট্য। যারা এ গান গাইত (বিশেষত হিন্দু), তাদের বলা হতো কবিয়াল। ১৮৫৪ সালে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রথম কবিগান সংগ্রহ করতে শুরু করেন এবং 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় প্রকাশ করেন।

প্র. কয়েকজন কবিয়ালের নাম বলুন?

উ. গোজলা গুই (কবিগানের আদি কবি), ভবানী বেনে, ভোলা ময়রা, হরু ঠাকুর, কেষ্টা মুচি, এন্টনি ফিরিঙ্গী, রামবসু, নিতাই বৈরাগী, নিধু বাবু।

প্র. শায়ের কারা?

উ. শায়ের আরবি শব্দ এবং এর অর্থ কবি। মুসলমান সমাজে মিশ্র (দোভাষী) ভাষারীতির পুঁথি রচয়িতাদের শায়ের বলা হতো। উল্লেখযোগ্য শায়েরগণ হলেন- ফকির গরীবুল্লাহ, সৈয়দ হামজা, মোহাম্মদ দানেশ, মালে মুহম্মদ, আব্দুর রহিম, আয়েজুদ্দিন।

প্র. পুঁথি সাহিত্য কী?

উ. অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রচিত 'আরবি-ফারসি' শব্দ মিশ্রিত ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ সাহিত্যকে পুঁথি সাহিত্য বলে। পুঁথি সাহিত্যের প্রথম ও সার্থক কবি ফকির গরীবুল্লাহ।

প্র. বটতলার পুঁথি কী?

উ. অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রচিত 'আরবি-ফারসি' শব্দ মিশ্রিত ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ সাহিত্য কলকাতার সন্তা ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়ে এই ধারার কাব্য দেশময় প্রচারিত হয়েছিল বলে একে 'বটতলার পুঁথি' নামে অভিহিত করা হয়।রেভারেন্ড জে. লং এ শ্রেণির রচনাকে 'মুসলমানি বাংলা সাহিত্য' বলে অভিহিত করেন।

কবি কৃষ্ণরাম দাসের 'রায়মঙ্গল' (১৬৮৬) কাব্য পুঁথি সাহিত্যের প্রথম কাব্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও এতে পুঁথি সাহিত্যের সকল বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হয়নি।

প্র. দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের প্রথম ও সার্থক কবি কে? (১৩তম বিসিএস লিখিত)

উ. ফকির গরীবুল্লাহ। 'আমীর হামজা' (১ম অংশ), 'জঙ্গনামা', 'ইউসুফ জোলেখা', 'সোনাভান', 'সত্যপীরের পুঁথি' তাঁর উল্লেখযোগ্য মিশ্র ভাষারীতির কাব্য।

প্র. দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের কবি সৈয়দ হামজার কাব্যগুলো কী কী?

উ. 'আমীর হামজা' (১৭৯৫- ২য় অংশ), 'জৈগুনের পুঁথি' (১৭৯৭), 'হাতেম তাই'।

প্র. টপ্পা গান কী?

উ. টপ্পা এক ধরনের গান। কবিগানের সমসাময়িককালে কলকাতা ও শহরতলিতে রাগ-রাগিনী সংযুক্ত এক ধরনের ওস্তাদি গানের প্রচলন ঘটেছিল, এগুলোই টপ্পা গান হিসেবে পরিচিত। টপ্পা থেকেই আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার সূত্রপাত বলে অনেকের ধারণা।  

প্র. বাংলা টপ্পা গানের জনক কে?

উ. রামনিধি গুপ্ত। তাঁর বিখ্যাত গান- 'নানান দেশের নানান ভাষা বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা'

প্র. পাঁচালী গানের জনপ্রিয় কবি কে?

উ. দাশরথি রায়। তিনি দাশুরায় নামে খ্যাত ছিলেন। উনিশ শতকের প্রথমদিকে পাঁচালী গান এদেশে জনপ্রিয় হয়েছিল।

প্র. শাক্ত পদাবলি কী?

উ. খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের পাশাপাশি শাক্তধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং একে ঘিরেই শাক্তগীতি চর্চার একটি ক্ষীণ ধারার প্রচলন ঘটে। শাক্ত পদাবলি শক্তি বিষয়ক গান। এই পদগুলিতে যেমন লিরিকধর্মীতা আছে তেমনি আছে বাঙালির চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার কথা। এ পদাবলির প্রধান রস বাৎসল্য যা ১২টি পর্যায়ে এবং দুটি ধারায় বিভক্ত। রামপ্রসাদ সেন এ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি শাক্ত পদাবলি বা শ্যামাসংগীত রচনায় পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ভক্তিভাব এবং রাগ ও বাউল সুরের মিশ্রণে এক ভিন্ন সুরের সৃষ্টি করেন, যা বাংলা সংগীত জগতে 'রামপ্রসাদী সুর' নামে পরিচিত। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁকে 'কবিরঞ্জন' উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হলো- 'বিদ্যাসুন্দর', 'কালীকীর্তন'।  

 

Reference: অগ্রদূত বাংলা