রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান

রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান

বাংলা অনুবাদ কাব্যের সূচনা হয় মধ্যযুগে। মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে সুলতানি আমলে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মুসলমান কবিগণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। প্রাচীন ও মধ্যযুগে হিন্দু-বৌদ্ধ রচিত বাংলা সাহিত্যে দেব-দেবীই প্রধান ছিল, মানুষ ছিল অপ্রধান। মুসলমান রচিত বাংলা সাহিত্যেই প্রথম মানুষ প্রাধান্য পায়। ফারসি বা হিন্দি সাহিত্যের উৎস থেকে উপকরণ নিয়ে রচিত অনুবাদমূলক প্রণয় কাব্যগুলোতে প্রথমবারের মতো মানবীয় বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে।  

 

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর

প্র. বাংলা ভাষার প্রথম মুসলিম কবি কে? [২৫তম বিসিএস লিখিত]

উ. শাহ মুহম্মদ সগীর। তিনি রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার প্রথম বাঙালি মুসলিম কবি।

প্র. রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য কী? [৩০তম বিসিএস লিখিত]

উ. মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মুসলিম কবিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে ও পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিদের প্রথম পদার্পণ ঘটে। এ কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

  • প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধর্মকেন্দ্রিক ও দেবতাকেন্দ্রিক রচনা ছেড়ে এ কাব্যে প্রথমবারের মতো মানবীয় বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়।  
  • এগুলো বাংলা ও বাঙালির কাহিনী নয়, বাইরে থেকে অনুবাদ করে নিজস্ব রূপ দেয়া।
  • গতানুগতিক সাহিত্যধারার বাইরে নতুন ভাবনা-চিন্তা ও রস-মাধুর্যের পরিচয় প্রকাশ করা।

প্র. ‘ইউসুফ জোলেখা’ কে অনুবাদ করেন? [২৭/১৫/১০তম বিসিএস লিখিত]

উ. শাহ মুহম্মদ সগীর। তিনি আবদুর রহমান জামি রচিত ‘ইউসুফ ওয়া জুলায়খা’ (তথ্যসূত্র: ওয়াকিল আহমেদ সম্পাদিত ‘বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান’ এর অন্তর্ভুক্ত ‘ইউসুফ জোলেখা’, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সম্মান শ্রেণির পাঠ্য) থেকে বাংলায় ‘ইউসুফ-জোলেখা’ নামে অনুবাদ করেন। এ কাব্যের পটভূমি ইরান।

প্র. ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যের কাহিনী সংক্ষেপে লেখ।

উ. ইউসুফ জোলেখা কাব্যের কাহিনী: তৈমুর বাদশা দেবধর্ম আরাধনা করে এক কন্যারত্ন লাভ করেন; তাঁর নাম রাখেন জোলেখা। অসামান্য সুন্দরী জোলেখা পর পর তিনবার দেবতুল্য এক যুবাপুরুষকে স্বপ্নে দেখে তাঁর প্রণয়াসক্ত হন। স্বপ্নের নির্দেশমতো জোলেখা মিশরের বাদশা আজিজ মিশিরকে বরমাল্য দিলেন, কিন্তু আজিজ মিশির স্বপ্নদৃষ্ট ব্যক্তি ছিলেন না। দৈববাণী কর্তৃক আশ্বাস লাভ করে জোলেখা ভারাক্রান্ত মন ও প্রণয়পীড়িত দেহ নিয়ে কালযাপন করেন। এদিকে কেনান দেশের ইয়াকুব নবীর পুত্র ইউসুফের ভবিষ্যৎ সৌভাগ্যের ও কৃতিত্বের ঈর্ষাকাতর বৈমাত্রেয় দশ ভ্রাতা তাকে কূপে নিক্ষেপ করে হত্যা করার চেষ্টা করে। মনিরু নামের মিশরবাসী এক বণিক ইউসুফকে কূপ থেকে উদ্ধার করে মিশরে নিয়ে যান এবং দাসরূপে বিক্রয় করেন। জোলেখার অনুরোধক্রমে আজিজ মিশির তাকে খরিদ করেন এবং নিজ অন্তঃপুরে নিয়ে যান। ইউসুফের রূপমুগ্ধ জোলেখা প্রেম নিবেদন করলে ইউসুফ ধর্মভয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। জোলেখা ছল, প্রতারণা করে ইউসুফকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।  

কিন্তু কিছুকাল পরে আজিজ মিশিরের স্বপ্ন ব্যাখ্যা করে ইউসুফ মুক্তিলাভ করেন এবং মিশরের মন্ত্রিত্ব পান। ইউসুফ দক্ষতার সাথে রাজকার্য পালন করেন এবং আজিজ মিশিরের মৃত্যুর পর তিনি মিশরের সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী হন। জোলেখা বৃদ্ধা ও অন্ধত্বপ্রাপ্ত হয়ে ইউসুফের সাক্ষাতের আশায় পথে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরিশেষে একদিন সাক্ষাৎ হয় এবং ইউসুফের প্রার্থনায় জোলেখা হৃতযৌবন ও রূপসৌন্দর্য ফিরে পান। উভয়ে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। যথাসময়ে তারা দুটি পুত্রসন্তান লাভ করেন। পরপর কয়েক বছর অনাবৃষ্টির কারণে চতুর্দিকে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। ইয়াকুব নবী উপায়ন্তর না দেখে স্বীয় পুত্রদের খাদ্যের সন্ধানে মিশরে প্রেরণ করেন। ইউসুফ অত্যাচারী ভ্রাতাদের চিনতে পারেন, কিন্তু পরিচয় গোপন করে তাদের  আদর-আপ্যায়ন করেন এবং প্রচুর খাদ্যশস্য দিয়ে বিদায় দেন। তাঁরা ইবনে আমিনকে নিয়ে দ্বিতীয়বার মিশরে গেলে ইউসুফ কেবল সহোদর আমিনকে নিজ পরিচয় দেন এবং ছলে 'সোনার কাঠা' চুরির অপবাদ দিয়ে বন্দি করে নিজের কাছে রাখেন। পিতা ইয়াকুবকে মিশরে আনার জন্য দ্রুতগামী অশ্ব দিয়ে বৈমাত্রেয় ভ্রাতাদের বিদায় করেন।ইয়াকুব মিশরে উপনীত হলে ত্রিশ বছর পর পিতা-পুত্রের মিলন হয়। ইউসুফ ভ্রাতাদের রাজকীয় দায়িত্ব দিয়ে মিশরে রাজত্ব করেন।

কিছুকাল পরে বারহা-তনয়ার সাথে জ্যেষ্ঠপুত্রের এবং নৃপতি আমির-তনয়ার সাথে কনিষ্ঠপুত্রের বিবাহ দেন। অতঃপর ইউসুফ দিগ্বিজয়ে বের হন। অনেক রাজ্য জয়ের পর মৃগয়ার সময়ে মধুপুরের রাজা শাহাবাগের রূপবতী কন্যা বিভুপ্রভার সাক্ষাৎ পান। বিভুপ্রভার ঈদ্দিত পাত্র ইবন আমিনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। অপুত্রক শাহাবাল জামাতাকে মধুপুর রাজ্য দান করেন। ইউসুফ মিশরে প্রত্যাবর্তন করেন। কিছুকাল পরে ইবনে আমিন ও বিধুপ্রিয়া মিশরে এসে বৃদ্ধ ইয়াকুবের পদবন্দনা করেন। জোলেখা বিধুপ্রভাকে বরণ করেন। ইউসুফ মিশরে এবং ইবন আমিন মধুপুরে সুখে রাজত্ব করেন।

প্র. 'লায়লী-মজনু' কে অনুবাদ করেন?/২৭/১৫/১০তম বিসিএস লিখিত।

উ. দৌলত উজির বাহরাম খান। তিনি পারসিয়ান কবি জামির 'লায়লা ওয়া মজনুন' থেকে এটি বাংলায় অনুবাদ করেন। এর উৎস আরবি লোকগাঁথা।

প্র. 'লায়লী-মজনু' কাব্যের কাহিনী সংক্ষেপে লেখ।

উ. লায়লী-মজনু কাব্যের কাহিনী:

আরবের এক ধনী আমির বহু দয়া-ধ্যান করে একটি পুত্র সন্তান লাভ করেন, তার নাম রাখেন কয়েস। পাঠশালায় পড়ার সময়ে মালিক নন্দিনী লায়লীর সাথে কয়েসের সাক্ষাৎ ও প্রণয় হয়। লায়লীর মাতা লায়লীর প্রেমকথা জানতে পেরে কুল-কলঙ্কের ভয়ে তার পাঠ বন্ধ করে দেন এবং কয়েসের সাথে সাক্ষাৎ বা পত্রবিনিময় যাতে করতে না পারে, তার জন্য সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বন্দিনী লায়লী কেবল বিলাপ ও অশ্রুপাত করে কালযাপন করে। এদিকে প্রেমপরাহত কয়েস ভিখারী ছদ্মবেশে লায়লীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে ধরা পড়ে এবং মালিকের নির্দেশে প্রহরী কর্তৃক নির্যাতিত হয়। লায়লীর প্রেমধ্যান করে কয়েস গৃহত্যাগ করে নজদ বনে আশ্রয় নেয়। প্রেমোন্মত্ত ও বিরহকাতর কয়েসের নাম হয় 'মজনু' (পাগল)। আমির অনেক চেষ্টা করেও মজনুর মতি-পরিবর্তন করতে পারেননি।

গৃহে আত্মীয় পরিজন-সহচরী পরিবেষ্টিত থেকেও লায়লী বিরহ-যন্ত্রনা ভোগ করে ও অনবরত বিলাপ করে। আমিরের অনুরোধে মালিক লায়লী মজনুর বিবাহে সম্মত হন, কিন্তু বিবাহবাসরে মজনুর প্রেমোন্মত্ততার কারণে তা ভেঙ্গে যায়। মজনু নজদ বনে ফিরে যায় এবং লায়লীর প্রেমধ্যান করতে করতে ঈশ্বরপ্রেমে মগ্ন হয়। আমির আশা ভঙ্গে ও পুত্রশোকে প্রাণত্যাগ করেন। ইবন সালামের পুত্রের সাথে লায়লীর বিবাহ হয় বটে কিন্তু বাসরঘরে লায়লীর পদাঘাত পেয়ে নববর গৃহত্যাগ করে চলে যায়। 

এক বৃদ্ধার মুখে মজনু লায়লীর বিবাহ-সংবাদ পেয়ে 'হৃদয়শোণিতে' তাকে পত্র দেয়। লায়লীর পত্র পেয়ে মজনু শান্ত হয়। নয়ফল-রাজ মৃগয়ায় এসে মজনুকে উদ্ধার করেন এবং মালিককে যুদ্ধে পরাভূত করে লায়লীকে বন্দি করেন। পরে লায়লীর রূপে তিনি নিজেই বন্দি হন এবং বিষপান করিয়ে মজনুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। সাকীর প্রমাদে বিষমিশ্রিত পানীয় পান করে নয়ফল-রাজ মৃত্যুবরণ করেন। পিতা লায়লীকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। কিছুকাল পরে পিতামাতার সাথে শ্যামদেশে যাওয়ার পথে লায়লী নিজেই উট চালিয়ে নজদ বনে যায় এবং মজনুর সাথে মিলিত হয়। কলঙ্কের ভয়ে মজনু লায়লীকে ফিরিয়ে দেয়। বিরহতাপানলে দগ্ধ হয়ে লায়লী মৃত্যুবরণ করে; শোকে মুহ্যমান মজনুও লায়লীর কবরে বিলাপ করতে করতে প্রাণত্যাগ করে।

মূলগ্রন্থমূল রচয়িতাঅনূদিত গ্রন্থ অনুবাদক ভাষা থেকে 
মহাভারতবেদব্যাসমহাভারতকবীন্দ্র পরমেশ্বর, কাশীরাম দাস, শ্রীকর নন্দী, সঞ্জয় গৌর, ষষ্ঠীবন সেন, গঙ্গা দাস, দ্বৈপায়ন দাস, নিত্যানন্দ দাস সংস্কৃত থেকে 
রামায়ণবাল্মীকিরামায়ণকৃত্তিবাস ওঝা, চন্দ্রাবতী, দ্বিজ ভবানী দাস, নিত্যানন্দ আচার্য 
ভাগবতবেদব্যাস শ্রীকৃষ্ণবিজয়মালাধর বসু 
বিদ্যাসুন্দরম বররুচি বিদ্যাসুন্দরসাবিরিদ খান 
ইউসুফ ওয়া জুলায়খা জামীইউসুফ জোলেখা শাহ মুহম্মদ সগীর, আবদুল হাকিম, গরীবুল্লাহফারসি থেকে 
লায়লা ওয়া মজনুন জামীলায়লী-মজনু দৌলত উজির বাহরাম খান 
--জঙ্গনামা গরীবুল্লাহ 
--নুরনামা আবদুল হাকিম 
তাজুলমূলক গুল-ই বকাগুলী)ইজ্জতুল্লাহ গুলে বকাওলী নওয়াজিস খান, মুহম্মদ মুকীম  
আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা-হাতেম তাই সৈয়দ হামজা, সাদতুল্লাহ  
হপ্ত পয়করনিজামীহপ্ত পয়করআলাওল 
সিকান্দরনামানিজামীসিকান্দরনামা 
তুহুফ-এ-নসাঈহইউসুফ গদাতোহফা (নীতিকাব্য) 

সয়ফুলমুলুক

বদিউজ্জামাল

গওযাসী

সয়ফুলমুলুক

বদিউজ্জামাল

 
 
পদুমাবৎমালিক মুহম্মদ জায়সী পদ্মাবতীআলাওলহিন্দি থেকে
মধুমালতীমনঝনমনঝনমুহম্মদ কবীর, সৈয়দ হামজা, শাকের মুহম্মদ
মৈনাসতসাধনলোরচন্দ্রাণী ও সতীময়নাদৌলত কাজী, আলাওল
Reference: অগ্রদূত বাংলা