বৈষ্ণব পদাবলি

বৈষ্ণব পদাবলি

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বৈষ্ণব পদাবলি, যা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে রচিত। চতুর্দশ শতকের শেষদিকে এগুলো কবিতা আকারে রচিত হতে থাকে। কোনো বিশেষ ধর্মীয় আবেগে রচিত হয়নি বৈষ্ণব পদাবলি। শ্রী চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রচার করেন ‘বৈষ্ণব ধর্ম’ এবং এর পর থেকে বাংলা কবিতায় বৈষ্ণব দর্শন স্থান পেতে থাকে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে এই সৃষ্টিসম্ভার প্রাচুর্য ও উৎকর্ষপূর্ণ ছিল। এর বিষয়বস্তু হলো রাধা ও কৃষ্ণের (রূপকাশ্রয়ে ভক্ত ও ভগবান) প্রেমলীলা। এতে মূলত স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। কেবল বৈষ্ণব ধর্মানুসারীরা এগুলো রচনা করেননি, অসংখ্য মুসলমান কবিও রয়েছে যারা পরম আবেগে বৈষ্ণব পদাবলি রচনা করেন। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে ১৬৪ জন বৈষ্ণব পদকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন।  

সমাজে ‘মহাজন পদাবলি’ এবং বৈষ্ণব পদকর্তাগণ ‘মহাজন’ নামে পরিচিত। বৈষ্ণবদের উপাস্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর প্রেমময় প্রকাশ ঘটেছে রাধার মাধ্যমে।

 

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর

প্রশ্ন: কবে বৈষ্ণব পদাবলির বিকাশ ঘটে?

উত্তর: চতুর্দশ শতাব্দীর শেষে এর রচনা শুরু হলেও শ্রী চৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্ম মতবাদ প্রচার শুরু করলে ষোড়শ শতাব্দীতে বৈষ্ণব পদাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়।

প্রশ্ন: বৈষ্ণব পদাবলিতে কৃষ্ণ ও রাধা কে?

উত্তর: বৈষ্ণব পদাবলিতে কৃষ্ণ পরমাত্মার এবং রাধা জীবাত্মার প্রতীক।

প্রশ্ন: বৈষ্ণব পদাবলি কে সংকলন করেন?

উত্তর: বাবা আউল মনোহর দাস। ষোড়শ শতকের শেষার্ধে তিনি ‘পদসমুদ্র’ গ্রন্থে বৈষ্ণব পদাবলি সংকলিত করেন। এতে প্রায় পনের হাজার কবিতা ছিল।

প্রশ্ন: বৈষ্ণব পদাবলিতে কতটি রস আছে?

উত্তর: ৫টি। যথা: শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। এ পদাবলিতে বৈষ্ণব তত্ত্বের প্রতিফলন ঘটেছে। শ্রীকৃষ্ণের ও তার প্রেয়সীভাবাপন্ন ভক্তদের যে মধুর সম্বন্ধ এবং এই প্রিয় সম্বন্ধজনিত পরস্পরের মধ্যে যে সম্ভোগ ভাব তার নাম মধুররস। [বাংলা সাহিত্যে রস ৯ প্রকার। যথা: শৃঙ্গাররস, বীররস, রৌদ্ররস, বীভৎসরস, হাস্যরস, অদ্ভুতরস, করুণরস, ভয়ানকরস ও শান্তরস]।

প্রশ্ন: পদ বা পদাবলি বলতে কী বুঝায়?

উত্তর: পদ বা পদাবলি বলতে প্রধানত শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলা নিয়ে গান করার জন্য রচিত প্রশংসাসূচক কবিতা বা বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব ধর্মের গূঢ় বিষয়কে নিয়ে রচিত সাহিত্যকে বুঝায়। মধ্যযুগে ‘পদাবলি’ সাহিত্যে ধর্মীয় ভাব প্রকাশের অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচিত হতো। হিন্দুদের উপনিষদে যে ব্রাহ্মকে রসস্বরূপ বলা হয়েছে এবং প্রিয়রূপে উপাসনা করতে বলা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণকে সেই অনন্তরসের আধার আস্বাদন করার জন্য পদাবলি সাহিত্য রচিত হয়েছে। দ্বাদশ শতকে বাঙালি কবি জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যে ‘পদাবলি’ শব্দটি প্রয়োগ করেন। পদাবলির বৃহত্তম ও অধিক সমাদৃত সংকলন বৈষ্ণবদাস ওরফে গোকুলানন্দ সেনের ‘পদকল্পতরু’। এতে মোট ৩১০১টি পদ সংকলিত হয়েছে। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী সংকলিত ‘ক্ষণদাগীতচিন্তামণি’কে প্রাচীনতম পদাবলি সংকলন বলে ধরে নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, শ্রীচৈতন্যেকে নিয়েও পদাবলি সাহিত্য রচিত হয়েছে।

প্রশ্ন: বৈষ্ণব পদাবলির প্রথম পদকর্তা কাকে বলা হয়?

উত্তর: বাঙালি কবি জয়দেবকে (রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি) বৈষ্ণব পদাবলির প্রথম পদকর্তা বলা হয়। তিনি দ্বাদশ শতকে সংস্কৃত ভাষায় ‘গীতগোবিন্দম’ নামে কাব্য রচনা করেন। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এ কাব্যের মূল বিষয়। এটি তিনি ২৮৬টি শ্লোক এবং ২৪টি গীতের সমন্বয়ে ১২টি সর্গে রচনা করেন।

প্রশ্ন: ‘মৈথিল কোকিল’ কাকে বলা হয়?

উত্তর: মিথিলার কবি বিদ্যাপতিকে ‘মৈথিল কোকিল’ বলা হয়। তিনি পদাবলির আদি বৈষ্ণব কবি এবং পদসংগীত ধারার রূপকার। তাঁর উপাধি ‘কবি কণ্ঠহার’। তাকে ‘অভিনব জয়দেব’ নামে ডাকা হত। তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি পংক্তি না লিখেও বাংলায় স্মরণীয় কবি। তিনি ব্রজবুলি ভাষায় রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা করেন।

প্রশ্ন: বৈষ্ণব পদাবলি কী? (২৯তম বিসিএস লিখিত)

উত্তর: মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক নিদর্শন বৈষ্ণব পদাবলি, যা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে রচিত। বৌদ্ধ বা বৈষ্ণবীয় ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব বিষয়ক সৃষ্ট পদ বা পদাবলিই ‘বৈষ্ণব পদাবলি’। এতে কৃষ্ণ পরমাত্মার প্রতীক এবং রাধা জীবাত্মার প্রতীক। বৈষ্ণবেরা ভগবান ও ভক্তের সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণকে পরমাত্মা বা ভগবান এবং রাধাকে জীবাত্মা বা সৃষ্টির রূপক মনে করে তাদের বিচিত্র প্রেমলীলার মধ্যেই ধর্মীয় তাৎপর্য উপলব্ধি করেছেন। ফলে এক প্রাচীন গোপজাতির লোকগাঁথার নায়ক প্রেমিক কৃষ্ণ এবং মহাভারতের নায়ক অবতার কৃষ্ণ কালে কালে লোকস্মৃতিতে অভিন্ন হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণব পদাবলি বৈষ্ণব

প্রশ্ন: বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলির আদি কবি কে?

উত্তর: চন্ডীদাস।

প্রশ্ন: বৈষ্ণব পদাবলির অন্যান্য কবি কে কে?

উত্তর:  বৈষ্ণব পদাবলির অন্যান্য কবিগ্ণঃ

জ্ঞানদাস: আনুমানিক ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান জেলার কাঁদড়া গ্রামে কবি জ্ঞানদাসের জন্ম। তিনি চন্ডীদাসের ভাবশিষ্য ছিলেন। চন্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের পদের মধ্যে যথেষ্ঠ সাদৃশ্য আছে। জ্ঞানদাস ছিলেন শিল্পী এবং চণ্ডীদাস ছিলেন সাধক।

গোবিন্দদাস: কবি বিদ্যাপতির ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ কবি ও ব্রজবুলি ভাষার স্রষ্টা গোবিন্দদাস। গোবিন্দদাসের আসল পদবি সেন।গোবিন্দদাসের কবিত্বগুণের সাথে বিদ্যাপতির ভাবের বিশেষ মিলের কারণে কবি বল্লভদাস তাঁকে 'বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য' অভিধা প্রদান করেন। তাঁর পদাবলিতে রাধা চরিত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ও পরিণতি লক্ষ করা যায়।

প্রশ্ন. চণ্ডীদাস সমস্যা কী? (৩১তম বিসিএস লিখিত)

উত্তর. মধ্যযুগে বাংলা কাব্য সাহিত্যে প্রায় চারজন চণ্ডীদাসের কবিতা পাওয়া যায়। এরা হলেন: ক. বড়ু চণ্ডীদাস, খ. দ্বিজ চণ্ডীদাস, গ. দীন চণ্ডীদাস, ঘ. চণ্ডীদাস। এ চারটি নামের মধ্যে শেষ তিনটি নাম এক নাকি ভিন্ন তা নিশ্চিত হওয়া যায় নি। এ সমস্যাই চণ্ডীদাস সমস্যা।

প্রশ্ন. বৈষ্ণব পদাবলির অধিকাংশ পদ কোন ভাষায় রচিত?

উত্তর. ব্রজবুলি। (এটি বাংলা ও মৈথিলি ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি কৃত্রিম ভাষা)

প্রশ্ন. ব্রজবুলি কী? [৩৬তম বিসিএস লিখিত]

উত্তর. ব্রজবুলি হলো বাংলা ও মৈথিলি ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি একপ্রকার কৃত্রিম কবিভাষা। মিথিলার কবি বিদ্যাপতি এ ভাষার স্রষ্টা। এ ভাষা কখনো মানুষের মুখের ভাষা ছিল না; এটি একটি কৃত্রিম ভাষা। এর সাহিত্যকর্ম ব্যতীত অন্যত্র এর ব্যবহার নেই। এতে কিছু হিন্দি শব্দ আছে। এ ভাষায় চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস বিভিন্ন বৈষ্ণব পদ রচনা করেন।

Reference: অগ্রদূত বাংলা