অন্ধকার যুগ (১২০১-১৩৫০)
১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের ফলে বাংলার প্রচলিত ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বড় পরিবর্তন ঘটে। ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধশক্তির নেতৃত্ব চলে যায় মুসলমানদের হাতে। নেতৃত্ব পরিবর্তনে সাময়িকভাবে সৃষ্ট এই বিমূঢ় অবস্থার প্রেক্ষিতে তেমন কোনো সাহিত্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি, তাই ঐতিহাসিকদের মতে, এ সময়কে অন্ধকার যুগ বলে।
প্র. বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগের ব্যাপ্তি কত?
উ. ১২০১-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ (তুর্কি শাসনামল)।
প্র. অন্ধকার যুগের সাহিত্যকর্মগুলো কী কী?
উ. 'প্রাকৃতপৈঙ্গল': এটি ত্রয়োদশ শতকে প্রাকৃত ভাষায় শ্রীহর্ষ রচিত গীতিকবিতার মহাসঙ্কলন যা অন্ধকার যুগের প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন।
'শূন্যপুরাণ': এটি রামাই পণ্ডিত রচিত ৫১টি অধ্যায় সম্বলিত সংস্কৃত ভাষায় গদ্য পদ্য মিশ্রিত চম্পুকাব্য। এর মূল নাম পাওয়া যায়নি, তাই নগেন্দ্রনাথ বসু রামাই পণ্ডিতের ভূমিকায় পাওয়া শূন্যপুরাণ অনুসারে এর নাম রাখেন 'শূন্যপুরাণ' বা এতে শূন্যময় দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজা পদ্ধতির বর্ণনা আছে বলেই এর নাম রাখা হয় 'শূন্যপুরাণ'। 'নিরঞ্জনের রুম্মা' বা 'নিরঞ্জনের উষ্মা' এ কাব্যের অংশ বিশেষ। নগেন্দ্রনাথ বসু তিনটি পুঁথিপাঠ সংগ্রহ করে 'শূন্যপুরাণ' নামে 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' থেকে এটি প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে বৌদ্ধদের শূন্যবাদ এবং হিন্দুদের লৌকিক ধর্মের মিশ্রণ ঘটেছে। এ গ্রন্থের অন্তর্গত 'নিরঞ্জনের রুম্মা' বা 'নিরঞ্জনের উম্মা' কবিতায় ব্রাহ্মণ্য শাসনের বদলে মুসলিম শাসন প্রবর্তনের পক্ষে মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে।
'সেক শুভোদয়া': রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্র সংস্কৃত ভাষায় গদ্য পদ্যে (চম্পুকাব্য) ২৫টি অধ্যায়ে এটি রচনা করেন। শেখের শুভোদয় অর্থাৎ শেখের গৌরব প্রচারই এর মূল উপজীব্য। এ গ্রন্থে মুসলমান দরবেশের চরিত্র ও আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, যা বাংলা ভাষায় রচিত পীর মাহাত্ম্যজ্ঞাপক কাব্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। এখানে বর্ণিত প্রেমসংগীতটিকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রেমসংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্র. বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলতে কী বুঝায়? (৪৩/৩০তম বিসিএস লিখিত)
উ. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ১২০১-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে অন্ধকার যুগ বলে। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা দখলের ফলে সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হওয়ার কারণে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারেনি।
ওয়াকিল আহমদের মতে, 'প্রথমে সেন ও পরে পাঠান আমলে সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পটভূমি পরিবর্তিত হলে সহজিয়া সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি ঘটে। ফলে তাদের ধর্মসাধনা ও জ্ঞানসাধনা রুদ্ধ হয়; সেই সাথে বাংলা সাহিত্য চর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, কেননা ঐ যুগে সহজিয়াগণই বাংলা ভাষার একমাত্র ধারক ও বাহক ছিলেন'। তবে অনেক সাহিত্যিকের মতে, সে সময়ে বিশেষ কোনো সাহিত্য পাওয়া না গেলেও 'শূন্যপুরাণ', 'সেক শুভোদয়া' প্রভৃতি সাহিত্য রচিত হয়েছিল। যেহেতু দু'একটা গ্রন্থের উপর নির্ভর করে একটি সময়কে নির্ণয় করা দুষ্কর, তাই এ সময়কে অন্ধকার যুগ বলে। এক কথায় বলা যায়, এ সময়কালে যে তিনটি গ্রন্থ পাওয়া গিয়েছে, সেগুলোর কোনোটিই বাংলা ভাষায় রচিত ছিল না। যেহেতু যুগকে ভাগ করা হয়েছে বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের উপর নির্ভর করে। সুতরাং বাংলা সাহিত্যের অনুপস্থিতির জন্য এ সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে। (যদিও এটি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে)।